নিরক্ষর কে ? যার কাছে লেখা শব্দ দুর্বোধ্য আঁকিবুঁকি মাত্র, সে ? লেখা
শব্দের মনে, নিঃশাসে-প্রশাসে, রক্তে যে গভীর প্রাণের ডাক, তা যার কানে
পৌঁছায় না, সে ? যে বাহ্যিক জগতের দৃশ্য স্পর্শ গন্ধের ত্রি-সীমানা পেরিয়ে
অক্ষরের ডানা মেলে অজানা জ্ঞানের অন্তরীক্ষে পৌছাতে জানে না, সে ? যে উইক
এন্ডে কফি হাউসে শক্তি-জয়-শ্রীজাত কপচাতে জানে না, সে ? তার কাছে জগত
কেমন ? নারকেলের বাইরেটা যেমন, তেমন ? নিরস, গদ্যময় ? নাকি অন্ধকার বস্তির
এঁদ গলির মত স্যাঁতস্যাঁতে, এক-রঙা ? চাঁদ তার কাছে কেমন ? দূরের প্রিয়ার
মত কাব্যিক নিশ্চই নয় ! তাহলে কি ঝলসানো রুটি ? নাকি ডমিনোস পিত্জা ? আর
এই আমরা, যারা ভাগ্যগুণে এই অক্ষরের জগতে বিল গেটস, তারা এই অভাগাদের কি
বলি ? নিরক্ষর ? তাদের ঘেন্না করি ? নাকি করুণা ? নাকি ব্যঙ্গ করে বলি
"আহা..বেচারা..বুঝলিই না কি রসে তোরা বঞ্চিত" !
কলকাতা থেকে ব্রাসেলস আসছি। মাঝে বোম্বেতে ফ্লাইট বদল করতে হলো । সেখানে ইমিগ্রেশনের ফর্ম ফিল-আপ করছি, এমন সময় এক ব্যক্তির অনুরোধ --"আমারটা একটু লিখে দেবেন দাদা ? আমি ইংরিজি পড়তে পারিনা" । কম বয়সী ছেলে, রুক্ষ চেহারা । আমারটা তখন প্রায় হয়ে গেছে । আমি সানন্দে তারটাও ফিল-আপ করে দিলাম । কিন্তু সেটা নিয়ে সে দুম করে চলে গেল ! একটা "ধন্যবাদ"ও না দিয়ে ! তখন বড্ড রাগ হলো ! মুখে কিছু বললাম না, কিন্তু মনের বাঁকা কোণে একটা শব্দ যেন গর্জে উঠলো -- "নিরক্ষর" ! ইশ ! কি ঘৃণ্য মানসিকতা আমার ! একি ভাবছি মনে মনে ? ক্ষনিকের দুর্মতির জন্যে মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দিলাম ! কিন্তু তখন মনের ভাবখানা এমনই হয়েছিল, ভন্ডের মত মিথ্যে বলে ভালো মানুষ সাজতে চাই না ।
ব্রাসেলস পৌছালাম । এবার ট্রেনে করে লিউভেন ফিরব । ট্রেন স্টেশনে অটোমেটিক মেশিনে টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি সবই ডাচ এ লেখা ! সবাই এসে দিব্বি টিকেট কেটে যাচ্ছে, আর আমি বোকার মত চেয়ে চেয়ে দেখছি ! নিরুপায় হয়ে এক সহৃদয় বেলজিয়ানের কাছে সাহায্য চাইতে হলো ! এরপর প্রায় সব জায়গায় এই একই দুর্দশা ! শপিং সেন্টারে কোন জ্যাম কোন তেল কিনব বোতল বা প্যাকেট দেখে বুঝতে পারছি না, রাস্তা ঘাটে কোনটা সতর্কিকরণ কোনটা উপদেশ -- সবই বুঝতে সাহায্য নিতে হচ্ছে ! নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ রুগীর মত অসহায় মনে হচ্ছিল যাকে সব কাজের জন্যে অন্যের সাহায্য নিতে হয় ! একদিন বাস ধরার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি । ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট, ২০ মিনিট গেল বাসের দেখা নেই ! তখন এক জনৈক ভদ্রমহিলা বললেন (ইংরিজিতে), "বাস এই রুট দিয়ে আসবে না, রাস্তার কাজ চলছে কিনা ! এই যে লেখা আছে ওপরে" । "ওপরে" নাকি সত্যি লেখা ছিল, কিন্তু সেটা ডাচ ভাষায় ! একদিন বইয়ের দোকান দেখে বিপুল উত্সাহ নিয়ে ঢুকে পরলাম । সেখানেও বঞ্চনা ! সব বইই ডাচে ! মনে হলো সব জ্ঞানের রাস্তা যেন কেউ জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে ! যেখানে থাকি সেটা একটা ছাত্রাবাস । সেখানে কয়েকবার কিছু অনুষ্ঠানে গেছি । সেখানেও সবার মুখে ডাচ ! আমায় সামনে দেখে ভদ্রতার খাতিরে কেউ গোটা কেউ ভাঙ্গা ইংরিজিতে কথা বলে কিছুক্ষণ । কিন্তু আবার নিজেদের খোশ গল্পে তারা মাতৃ ভাষায় ফিরে যায় । তাই এত মানুষের মধ্যেও আমি বার বার একা হয়ে গেছি ! আমাদের কমন কিচেনে প্রায় সন্ধ্যায় দেখি তারা প্রাণ খুলে নানা বিষয়ে আলোচনা করে, হাসি ঠাট্টা করে, গম্ভীর বিশ্লেষণ করে । তার ওপরের তরঙ্গটুকু অনুভব করি মাত্র । ডুব দিতে গিয়ে দেখি আমার সাঁতার জানা নেই !
একদিন আয়নায় চুল আচরাতে গিয়ে নিজের সাথে দেখা হলো । নিজের চোখে চোখ রাখলাম । নিজের বুকে কান পেতে শুনলাম মনের সেই বাঁকা কোণে, কে যেন বলছে "নিরক্ষর" ! নিজের মুখের দিকে তাকালাম ! সত্যি ! তখন মনে পড়ল এয়ারপোর্টে ইংরিজি না জানা ছেলেটার কথা । হয়ত সেই ছেলেটার এই জ্বালা সইতে সইতে সহবত শেখার সময়ই হয়নি । তাই সে আমাদের মত সাক্ষরদের অতি প্রিয় "ধন্যবাদ" দিয়ে যায় নি ! কারণ ওগুলো তো সাক্ষরদের পেটেন্টেড জিনিস, জাতে না উঠলে সে অধিকার কি পাওয়া যায় ? আরও একটা জিনিস বুঝলাম । একজন মানুষ সাক্ষর না নিরক্ষর সেটা ঠিক করে তার অবস্থান । নিজ দেশে যে সাক্ষর, স্থানের ফেরে সে নিরক্ষর ! এই মহাজ্ঞানের সাগরে এক গন্ডুষ পেয়ে যারা ভাবেন আমি সবার সেরা, তাদের সিজন চেঞ্জের প্রয়োজন ! আরও একটা কথা সত্যি -- যতই বড় হই না কেন, অসীমের কাছে আমি সেই ছোটই থাকবো ! ওই যে সুদূর কালপুরুষ, ওই আকাশ গঙ্গা, এই বিশাল ব্রম্ভান্ড -- তার কাছে আমি এক ছোট্ট বিন্দু মাত্র ! এত ছোটো যে সেন্টিমিটার, মিলিমিটার, নানোমিটার -- কিছুতেই আমায় ধরা যাবে না ! সবার মনে এই ভাব যেদিন আসবে, সেইদিন হয়তো এই সর্বব্যাপী নিরক্ষরতা ঘুচবে, নচেত নয় ।
কলকাতা থেকে ব্রাসেলস আসছি। মাঝে বোম্বেতে ফ্লাইট বদল করতে হলো । সেখানে ইমিগ্রেশনের ফর্ম ফিল-আপ করছি, এমন সময় এক ব্যক্তির অনুরোধ --"আমারটা একটু লিখে দেবেন দাদা ? আমি ইংরিজি পড়তে পারিনা" । কম বয়সী ছেলে, রুক্ষ চেহারা । আমারটা তখন প্রায় হয়ে গেছে । আমি সানন্দে তারটাও ফিল-আপ করে দিলাম । কিন্তু সেটা নিয়ে সে দুম করে চলে গেল ! একটা "ধন্যবাদ"ও না দিয়ে ! তখন বড্ড রাগ হলো ! মুখে কিছু বললাম না, কিন্তু মনের বাঁকা কোণে একটা শব্দ যেন গর্জে উঠলো -- "নিরক্ষর" ! ইশ ! কি ঘৃণ্য মানসিকতা আমার ! একি ভাবছি মনে মনে ? ক্ষনিকের দুর্মতির জন্যে মনে মনে নিজেকেই ধিক্কার দিলাম ! কিন্তু তখন মনের ভাবখানা এমনই হয়েছিল, ভন্ডের মত মিথ্যে বলে ভালো মানুষ সাজতে চাই না ।
ব্রাসেলস পৌছালাম । এবার ট্রেনে করে লিউভেন ফিরব । ট্রেন স্টেশনে অটোমেটিক মেশিনে টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি সবই ডাচ এ লেখা ! সবাই এসে দিব্বি টিকেট কেটে যাচ্ছে, আর আমি বোকার মত চেয়ে চেয়ে দেখছি ! নিরুপায় হয়ে এক সহৃদয় বেলজিয়ানের কাছে সাহায্য চাইতে হলো ! এরপর প্রায় সব জায়গায় এই একই দুর্দশা ! শপিং সেন্টারে কোন জ্যাম কোন তেল কিনব বোতল বা প্যাকেট দেখে বুঝতে পারছি না, রাস্তা ঘাটে কোনটা সতর্কিকরণ কোনটা উপদেশ -- সবই বুঝতে সাহায্য নিতে হচ্ছে ! নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ রুগীর মত অসহায় মনে হচ্ছিল যাকে সব কাজের জন্যে অন্যের সাহায্য নিতে হয় ! একদিন বাস ধরার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি । ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট, ২০ মিনিট গেল বাসের দেখা নেই ! তখন এক জনৈক ভদ্রমহিলা বললেন (ইংরিজিতে), "বাস এই রুট দিয়ে আসবে না, রাস্তার কাজ চলছে কিনা ! এই যে লেখা আছে ওপরে" । "ওপরে" নাকি সত্যি লেখা ছিল, কিন্তু সেটা ডাচ ভাষায় ! একদিন বইয়ের দোকান দেখে বিপুল উত্সাহ নিয়ে ঢুকে পরলাম । সেখানেও বঞ্চনা ! সব বইই ডাচে ! মনে হলো সব জ্ঞানের রাস্তা যেন কেউ জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে ! যেখানে থাকি সেটা একটা ছাত্রাবাস । সেখানে কয়েকবার কিছু অনুষ্ঠানে গেছি । সেখানেও সবার মুখে ডাচ ! আমায় সামনে দেখে ভদ্রতার খাতিরে কেউ গোটা কেউ ভাঙ্গা ইংরিজিতে কথা বলে কিছুক্ষণ । কিন্তু আবার নিজেদের খোশ গল্পে তারা মাতৃ ভাষায় ফিরে যায় । তাই এত মানুষের মধ্যেও আমি বার বার একা হয়ে গেছি ! আমাদের কমন কিচেনে প্রায় সন্ধ্যায় দেখি তারা প্রাণ খুলে নানা বিষয়ে আলোচনা করে, হাসি ঠাট্টা করে, গম্ভীর বিশ্লেষণ করে । তার ওপরের তরঙ্গটুকু অনুভব করি মাত্র । ডুব দিতে গিয়ে দেখি আমার সাঁতার জানা নেই !
একদিন আয়নায় চুল আচরাতে গিয়ে নিজের সাথে দেখা হলো । নিজের চোখে চোখ রাখলাম । নিজের বুকে কান পেতে শুনলাম মনের সেই বাঁকা কোণে, কে যেন বলছে "নিরক্ষর" ! নিজের মুখের দিকে তাকালাম ! সত্যি ! তখন মনে পড়ল এয়ারপোর্টে ইংরিজি না জানা ছেলেটার কথা । হয়ত সেই ছেলেটার এই জ্বালা সইতে সইতে সহবত শেখার সময়ই হয়নি । তাই সে আমাদের মত সাক্ষরদের অতি প্রিয় "ধন্যবাদ" দিয়ে যায় নি ! কারণ ওগুলো তো সাক্ষরদের পেটেন্টেড জিনিস, জাতে না উঠলে সে অধিকার কি পাওয়া যায় ? আরও একটা জিনিস বুঝলাম । একজন মানুষ সাক্ষর না নিরক্ষর সেটা ঠিক করে তার অবস্থান । নিজ দেশে যে সাক্ষর, স্থানের ফেরে সে নিরক্ষর ! এই মহাজ্ঞানের সাগরে এক গন্ডুষ পেয়ে যারা ভাবেন আমি সবার সেরা, তাদের সিজন চেঞ্জের প্রয়োজন ! আরও একটা কথা সত্যি -- যতই বড় হই না কেন, অসীমের কাছে আমি সেই ছোটই থাকবো ! ওই যে সুদূর কালপুরুষ, ওই আকাশ গঙ্গা, এই বিশাল ব্রম্ভান্ড -- তার কাছে আমি এক ছোট্ট বিন্দু মাত্র ! এত ছোটো যে সেন্টিমিটার, মিলিমিটার, নানোমিটার -- কিছুতেই আমায় ধরা যাবে না ! সবার মনে এই ভাব যেদিন আসবে, সেইদিন হয়তো এই সর্বব্যাপী নিরক্ষরতা ঘুচবে, নচেত নয় ।
No comments:
Post a Comment