২০১১ সালে কোনো এক রবিবার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে দেখেছিলো
ISI-এর প্রসেনজিৎ-দা, জিয়া-দা, দীপা-দি, কণা (দীপাদির বোন) প্রভৃতিরা আমার
হাস্যময় "photogenic face" আর সেটি অঙ্কনরত জনৈক মিঠুন চক্রবর্তীকে । এখানে
বলে রাখি, এই মিঠুন চক্রবর্তী একজন পোর্ট্রেট শিল্পী, আমাদের ডিস্কো
ডান্সার মিঠুন-দা নন । এই শিল্পীর কাজই হলো আমার মতন "মুখের-ওপর-না" না
বলতে পারা, "photogenic face"- ধারী ব্যক্তি পাকড়াও করে নিমেষের মধ্যে
তাদের ছবি এঁকে এবং তাদেরকেই সেটা বিক্রি করে তাদের কাছে নিজের অসামান্য
প্রতিভার মূল্য আদায় করা ।
২০১১ সালে আমার সাথে এই ঘটনা
ঘটেছিলো। আজ আবার ঘটলো । অকস্মাৎ, বিশেষ কিছু ঠাহর করার আগেই ! শশুর বাড়ি
থেকে ফেরার সময় কি মনে হলো, একবার একাডেমির সামনেটায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম আর
প্রজাপতি বিসকুট সহযোগে চা সেবন করছিলাম । এমন সময় প্রায় মাটি ফুঁড়ে এই
শিল্পীর আবির্ভাব ঘটলো ! যেমন নাম, তেমনি কাম ! আমার সাথে ঠিক ২ মিনিটের
ভূমিকা -- "এই আপনাকে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে, আমি কিন্তু সবার ছবি আঁকি না,
আপনি মুখের ওপর 'নেহি চাহিয়ে' বলা বড়োলোকের ব্যাটা নন" ইত্যাদি । আমিও
ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুর্বল বিবাদী পক্ষের উকিলের মতো অচল যুক্তি ছুঁড়ে
দিচ্ছিলাম -- "মানে বলছি কি, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে, তায় মহরম... রাস্তায়
বাস কম, একটু তাড়া ছিলো" ইত্যাদি । কিন্তু আমার বিনীত অনুরোধে বিন্দুমাত্র
কর্ণপাত না করে ইতি মধ্যে শিল্পীর ক্ষিপ্র হস্তের পেন্সিল কার্ডবোর্ডে আঁটা
কাগজে ললিত কলা সৃষ্টি করতে শুরু করে দিয়েছে । আমি আরো বললাম -- "না মানে
আপনি কিন্তু বেশ কিছু দিন আগে আমার ছবি এঁকেছিলেন, সে ছবি এখনো আমার কাছে
রয়েছে" । এটা বলায় উনি থামলেন । আমি ভাবলাম, এইবার বোধ হয় ওষুধ ধরেছে ।
কিন্তু উল্টে আরও উৎসাহ পেয়ে শিল্পী বললেন -- "তবে ! হতেই হবে ! আমায় কি
হেঁজি পেঁজি পেয়েছেন নাকি ? আমার নাম মিঠুন চক্রবর্তী ! আর্টিস্ট ! তবে এ
ক'বছরে আমার হাত আরও খুলেছে ! আগেরটার সাথে এইটা মিলিয়ে নেবেন!" বলে
দ্বিগুণ উৎসাহে কাগজে পেন্সিল সঞ্চালন করতে লাগলেন । আশপাশের লোকজন উৎসুক
দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে, একবার শিল্পীর ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে চলে
যাচ্ছিলেন, কারো মুখে মিটি মিটি হাসি । আমার ঠিক বাম দিকে এক ডানপিটে
ধরণের মেয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো । সে ফোঁকা থামিয়ে চোখের সামনে জলজ্যান্ত
মূর্তিমান শিল্প অবলোকন করছিল । সামনের টিকেট কাউন্টারে অনুসন্ধানী লোকজন
এদিকে দেখে কিসব কানাকানি করছিলেন । আমিও লজ্জা লজ্জা মুখ করে তাদের দিকে
চাইছিলাম । তাই দেখে মৃদু হুকুম এলো "আমার দিকে তাকাবেন দাদা" ! হুকুম
তামিল হতেই তিনি বলে চললেন "আমার হাতের যে উন্নতি হয়েছে, একথা শুধু আমি
বলছি না দাদা । স্বয়ং দিদি বলেছেন ! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় !" আমি অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলাম "তা আপনি কি ওনারও ...?" "ধুর ওনার অত সময় কোথায় ?? কিন্তু
দিদি আমায় একাডেমির ভেতর জায়গা করে দিয়েছেন । দিদি জিন্দাবাদ ! আমার
সামনে ওনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে রক্তারক্তি হয়ে যাবে এক্কেবারে !" আমি
মনে মনে ভাবলাম "আমার ঘাড়ে কটা মাথা !" শিল্পী বলে চললেন (ওনার পেন্সিলের
চলাচল অব্যাহত) -- "তবে শর্মিলা দিদি -- ওই যিনি 'আরাধনা' করেছিলেন, ওনার
ছবি এঁকেছি ; রাজেশ খান্নার এঁকেছি, আপনাদের মিঠুনদার ছবি এঁকেছি । আজ
আপনার আঁকছি !" শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আর অসহায়
ভাবে চিত্রিত হওয়া ছাড়া আর কি করবো, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না! শিল্পীর
হাত আর মুখ একই গতিতে চলছিল। হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছিলাম এনার নামের
সার্থকতা ! শিল্পী বলে চলেছেন, ছবিতে ফিনিশিং টাচ দিতে দিতে, "তারকারা তো
একদিন আঁকাবেন, ৫০০ টাকা দেবেন, ব্যাস ! কিন্তু আপনারাই তো আমাদেরকে
বাঁচিয়ে রেখেছেন, নাহলে কি আর ছবি এঁকে পেট চলে দাদা "!
অবশেষে আমার পোট্রেট শেষ হলো (attached) । আমার খুব যে মনোপূতঃ হয়েছিল তা
নয়, কিন্তু মাত্র ৮-৯ মিনিটের মধ্যে এইটুকুও করা সহজ নয় । আমি এককালে
শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, প্রচুর ছবি আঁকতাম । কিন্তু একদিন নিজের চরম
অযোগ্যতা বুঝতে পেরে ইতি টানি ! তাই শিল্পীদের প্রতি আমার মনে অনেকখানি
সম্মান জমা রয়েছে, তা অনুভব করি কোনো শিল্পী এবং তাঁদের আঁকা ছবি দেখলেই ।
তাই হয়তো এবারেও মুখের ওপর না বলতে পারিনি । এছাড়া ২০১১ সালের সেই দিন আমরা
"চিরকুমার সভা" দেখেছিলাম, খুব ভালো লেগেছিলো ! সেই সব সোনালী দিনের
স্মৃতির ছবি মনে প্রাঞ্জল হয়ে উঠছিলো আজ এই পোর্ট্রেট আঁকানোর সময় । তাই
নির্বিবাদে শিল্পীকে তার কাঙ্খিত পারিশ্রমিক দিয়ে খুশি মনে বিদায় নিলাম
আমার নতুন পোর্ট্রেট নিয়ে । ওনার হাত আরও ভালো হয়ে যাওয়ার কারণে আগের
বারের চেয়ে কিছু বেশি নিলেন, বলাই বাহুল্য !