২০১৪
এর অক্টোবর মাসে রোম যাত্রার
সুযোগ হয়েছিল । উপলক্ষ এক
কনফারেন্সে একটি গবেষনার কাজ
পেশ করা । অনেক দিনের স্বপ্ন
ছিল ইতালির এই কাব্যময়,
শিল্পময়
শহর দেখার । অপ্রত্যাশিত ভাবেই
সুযোগটি হয় । অচিরেই আমার
স্বপ্ন বাস্তবের ডানা মেলে
উড়ে যায় এই প্রাচীন সাম্রাজ্যর
কেন্দ্রস্থলে । সন্ধ্যেবেলায়
রোমের Fiumicino বিমানবন্দর
পৌঁছালাম । Hello Roma
নামক এক চোট
হোটেলে আগেই বুকিং করা ছিলো
। হোটেল ম্যানেজার Aldo
খুব আপ্যায়ন
করে বিমানবন্দর থেকে আমায়
নিজের গাড়ি করে নিজের হোটেলে
নিয়ে গেল । তার আন্তরিকতায়
এবং রোমের স্নিগ্ধ
সান্ধ্য রূপে মন ভরে গেল |
(১)
রোমে
যে জায়গায় থাকতাম তার নাম
Viale Lionardo da Vinci | অর্থাত,
লীয়নার্দ
দা ভিন্চি সারণী । মহান ইতালিয়ান
শিল্পীর নামে নামকরণ |
প্রাচীন
শিল্পের নিদর্শন তেমন দেখা
যায়না । কিন্তু অনেক graphiti
দেখা যায় ।
Graphiti অর্থে
আধুনিক শিল্প যেখানে বিশেষ
spray রং
ব্যাবহার করে লেখা আর আঁকা
হয় | এই
জিনিস দিয়ে অনেক দেয়ালে,
দোকানের
shutter এ
সুন্দর ছবি আঁকা হয়েছে |
আবার এইটে
কখনো প্রতিবাদ বা মতামত প্রকাশের
ভাষা | এখানে
অনেক জায়গায় বড় বড় অক্ষরে অনেক
লেখা আর আঁকি বুঁকি দেখা যায়
। ইংরিজিতে দেখলাম “free
food”, “education” এইসব
লেখা আছে । অনেক রাজনৈতিক
বক্তব্য বোধ হয় লেখা ছিল |
ভাষাটা অজানা
বলে বুঝতে পারিনি ।
পথ
চলতে দু ধরনের ভাষা শোনা যায়
| প্রথমটা
বোধ হয় ইতালিয়ান । অবশ্য অন্য
কিছুও হতে পারে । দ্বিতীয়টি
হলো বাংলা ! আজ্ঞে
হ্যা ! আমিও
এই ভাবেই অবাক হয়েছিলাম প্রথমে
। এখানে এসেই রাস্তায় চলতে
চলতে চেনা শব্দ শুনে থমকে
গেলাম ! ভাবলাম
রাতে ভালো ঘুম হয়নি ,
এত jet
lag, তাই হয়ত
ভুল শুনছি ! আদরের
সোনার বাংলা হয়ত আমার মনের
অন্দরমহলে গুমরে মরচে !
তাই কান খাড়া
করে শুনলাম | হ্যা,
সত্যি বাংলা
বলছে ! অবশ্য
বাংলাদেশী কায়দায় । তারপর
মনে পড়ল আমার এই হোটেল এর
ম্যানেজার Aldo আগেই
বলেছিল এখানে অনেক বাংলাদেশী
থাকে । দেশে নিজের প্রতিবেশীকে
সব সময় আপন মনে হয়না । কিন্তু
বিদেশ বিভুই এ -
যেখানে সবাই
অচেনা, অচেনা
পথ ঘাট, অচেনা
ভাষা সংস্কৃতি -
সেখানে একজন,
যে আমার
মাতৃভাষায় কথা বলে,
তাকে যেন
কত কালের পরিচিত মনে হয় !
মনে হয় প্রবাসে
নিজের ঘরের উষ্ণতা অনুভব করছি
| এই
বাংলাদেশী বান্ধবদের কাছে
উপকারও পেয়েছি এ ক'দিনেই
| যাদের
সাথে আলাপ হলো তারা সবাই
দোকানদার বা কর্মচারী । ২০
তারিখ রাতে পৌছে রাতের খাবার
খুঁজছি । এক mini super
market এ ঢুকলাম
। সেখানে বিবিধ জিনিস পাওয়া
যায় । কিন্তু ঠিক dinner
এর উপযুক্ত
সেগুলো নয় । সেখানকার দোকানদার
বাংলাদেশী | তিনি
সঠিক খাবার দোকানের সন্ধান
দিলেন । কনফারেন্স শুরুর দিন
সকালে ফুটপাতে ঘোরা ফেরা করছি
| লোকজনকে
জিগ্গেস করছি কোন দিকে গেলে
কনফারেন্স এর জায়গায় পৌছানো
যায় | আমার
Nokia ফোনের
GPS টায়
তখন ঠিক ভরসা পাচ্ছিলাম না |
এক জায়গায়
হঠাত বলল "turn right"
। সেখানে
ডান দিকে তাকিয়ে দেখি এক মস্ত
গ্যারেজ ! তাই
লোক জনকে একটু জিজ্ঞাসা করছিলাম
| ফুটপাথে
বিবিধ জিনিস নিয়ে দুজন লোককে
দেখেই মনে হলো এনারা ইতালিয়ান
নন | ওনাদের
জিগ্গেস করাতে ওনারা যেমন
উচ্চারণে ইংরেজি বললেন তাতে
সহজেই বোঝা যায় যে এনারা বাঙালি
না হয়ে জাননা ! তাই
সটান বাংলায় জিগ্গেস করলাম
| তাঁরা
তখন হেসে সঠিক রাস্তারই সন্ধান
দিলেন । আবার একদিন রাতে
আইস-ক্রিম,
কেকের দোকানে
গেছি রাতের খাবার কিনতে । এক
কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারী আমায়
সম্ভবত ইতালিয়ান ভাষায় জিগ্গেস
করলো কি চাই | আমি
ইংরেজিতে বলাতে সে জিগ্গেস
করলো "Indian?” আমি
বললাম “Yes” | সে
তখন ভেতর থেকে আর একজন কর্মচারী
কে ডেকে আনলো | সেই
কর্মচারী বিনা কাল ব্যয় করে
বাংলায় জিগ্গেস করলো “বাংলাদেশ
থেকে আসছেন ?” আমি
হেসে বললাম না “কলকাতা” ।
তারপর সে যত্ন করে পাওরুটির
মধ্যে gelato আইসক্রিম
দিয়ে দিল | চার
রকম স্বাদের আইস-ক্রিম
: cranberry, coconut, mango আর
strawberry ।
ধন্যবাদ বলে বিদায় নিলাম ।
অবশ্য
খোদ ইতালিয়ানরাও বেশ উপকারী
| রাস্তা
ঘটে যখনই Nokia GPS কে
সন্দেহ হচ্ছিল,
তখনই জিগ্গেস
করতে হচ্ছিল । মুশকিল হচ্ছে
প্রায় কেউই ইংলিশ বোঝেনা !
যারা বোঝেন
তাঁরা শুধু কয়েকটা শব্দ বোঝেন
ব্যাস ! তাতে
মনের ভাব পুরোটা বোঝানো যায়না
। তবে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা
করছিলেন আমায় সাহায্যার্থে
, সে
বিষয়ে সন্দেহ নেই |
এখান থেকে
যাবার সময় আমি কিছু ইতালিয়ান
শব্দ শিখেছিলাম |
কিন্তু এখন
হাড়ে হাড়ে বুঝেছি,
অল্প বিদ্যা
জাহির করতে যাওয়াটা কতটা
বিপদজনক হতে পারে !
আমি একবার
বাহাদুরি করে এক ভদ্রলোককে
জিগ্গেস করলাম “albergo
Barcelo Aran Mantegna?” অর্থাত
হোটেল Barcelo Aran Mantegna,
যেখানে
কনফারেন্স হচ্ছিল,
সেইটির
ডাইরেকশন চাইছিলাম আর কি ।
উত্তরে ভদ্রলোক এমন গরগর করে
ইতালিয়ান বলে গেলেন যে আমার
নিজের ওপরই চরম রাগ আর বিতৃষ্ণা
জন্মে গেল ! কেন
বাবা যেচে অপদস্থ হওয়া !
এখানে বলে
রাখি সাধারণত ইতালিয়ানরা
বাঙালিদের তুলনায় তাড়াতাড়ি
কথা বলেন | অর্থাত
প্রতি মিনিটে গড়ে আমাদের চেয়ে
বেশি শব্দ বলেন । এবং সব শব্দ
শেষ হয় এক বিশেষ ইতালিয়ান সুরে
| কিন্তু
পুরোটাই যদি দুর্বোধ্য হয়,
তাহলে সেই
সুর রীতিমত আসুরিক যন্ত্রণা
দিতে পারে ! বাইরে
অবশ্য ভদ্রলোককে খুব নম্র
ভাবে "thank you" বলে
পথ চলা শুরু করলাম,
ভাবখানা এই
যে , সবিই
বুঝে গেছি ! এর
পরের জনকে সটান ইংলিশেই জিগ্গেস
করলাম | তিনি
ইংলিশ বোঝেন জেনে ধরে প্রাণ
এলো ! তার
নির্দেশেই আমার হোটেল -
প্রাপ্তি
ঘটল ! কনফারেন্স
ভেন্যু থেকে আমার বাসস্থান
ফিরতে একদিন ১৫ -
২০ মিনিটের
জন্যে হারিয়ে গেছিলাম |
তখনও পরিত্রাতা
কয়েকজন ইতালিয়ান !
কিন্তু
কয়েকটা ইতালিয়ান শব্দ ধরতে
পেরেছি | পরে
এসে google translate এ
মিলিয়ে নিয়েছি |
যেমন “dritto”
মানে সোজা
যাও, “sinistra” মানে
বাম দিকে , আর
“diritto” মানে
ডান দিক | আর
হ্যান, “la strada” মানে
রাস্তা, এটা
আগেই জানতাম | এই
নামে ফেদেরিকো ফেল্লিনির এক
বিখ্যাত সিনেমা আছে,
ইতালিয়ান
ছবি । আমার সংগ্রহে আছে,
যদিও এখনো
দেখা হয়নি ।
(২)
কনফারেন্স
এ আমার talk ছিল
প্রথম দিনই । তারপর আমি মুক্ত
বিহঙ্গ ! ভাবলাম
এইবার রোম সফরে বেরোনো যাক ।
ঠিক করলাম পরদিন কলোসিয়াম
দেখব । যেমন ভাবা তেমনি কাজ
। পরেরদিন সক্কাল সক্কাল
বেরিয়ে পরলাম মনে অসীম উত্সাহ
নিয়ে । মেট্রো করে "কলস্সেও"
নামক গন্তব্যে
পৌছালাম । মেট্রো স্টেশন থেকে
বেরোতেই দেখতে পেলাম সেই
গগনজোড়া, একমেবদ্বিতিয়ম
স্থাপত্য - কলোসিয়াম
! দেখে
মুগ্ধ, বিস্মিত
হয়ে গেলাম ! এত
বড় আর এত সুন্দর জিনিস চোখের
সামনে এর আগে কখনো দেখিনি !
ছবিতে অনেকবার
দেখেছি বটে, আমার
talk এর
শেষে "Thank You" slide
এও কলিসীয়াম
এর ছবি দিয়েছি |
কিন্তু সেটি
এত বড় হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি
! চোখের
আন্দাজে মনে হলো ব্যাপ্তিতে
ISI কলকাতার
পুরো ক্যাম্পাসটির মত হবে !
আর উচ্চতায়
আমাদের S.N. Bose Bhaban এর
১.৫
গুন হবে ! মানে
প্রায় ১৬ তলা বাড়ি !
আর অদ্ভুত
সুন্দর তার কলাকীর্তি !
যেমন প্রকান্ড,
তেমনি সুক্ষ
| দেখে
মনে হয় এক বিশাল শ্বেত বর্ণের
অপরুপা দেবী, আপন
খেয়ালে, নীল
আকাশের সাথে কথা বলছে |
ভেতরে
ঢুকতে গেলে ১২ ইউরোর টিকেট
কাটতে হয় | একা
একাও ঢোকা যায়, আবার
বিভিন্য ভাষায় "guided
tour" ও নেওয়া
যায় | আমি
একা একাই ঢুকলাম প্রাচীন
বিশালকায় পাথরের খিলানের
ভেতর দিয়ে | ভেতরে
ঢুকে জানলাম এটা আসলে ৩ তলার
| উঁচু
উঁচু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা
আছে | বাইরের
সৌন্দর্যের মোহ নিয়ে ভেতরে
প্রবেশ করতেই, এই
আচলোযতনের ভয়ংকর অমানবিক
ইতিহাস চোখে ভেসে ওঠে !
নিচের তলায়
পেল্লাই পেল্লাই অন্ধকারময়
সুরঙ্গ | এখানেই
হিংস্র জন্তুদের বেঁধে রাখা
হত | আর
রাখা হত গ্ল্যাডিয়েটরদের !
সম্রাটের
নির্দেশ পেলেই এই সুরঙ্গের
দ্বার খুলে দেওয়া হত |
সঙ্গে সঙ্গে
এক দিক থেকে রক্ত পিপাসু বাঘ
সিংহের দল, আর
অন্য দিক থেকে অসহায়,
নিরস্ত্র
বন্দিরা গিয়ে পরত সামনের arena
তে |
এই arena
তেই হত নৃশংস
রক্ত লীলা | হত
গ্ল্যাডিয়েটরদের নিশ্চিত
মৃত্যুর সাথে দ্বন্দযুদ্ধ
| বেশির
ভাগ সময়েই রোমাঞ্চকর প্রতিরোধ
আর পরাক্রম প্রদর্শনের পর
এই যোদ্ধারা পাশবিক শক্তির
কাছে পরাভূত হত !
আর এই কলোসিয়ামে
বসে থাকা প্রায় ৮০,০০০
দর্শক তা বিপুল আনন্দ ও উদ্দীপনায়
উপভোগ করত ! অবশ্য
এই মরণ খেলা ছাড়া আরও অন্য
খেলাও হত এখানে যেমন,
জাগ্লেরি,
আগুনের খেলা
ইত্যাদি | কিন্তু
বন্দিদের রক্তক্ষরণই ছিল
ক্রীড়ার প্রধান আকর্ষণ !
সিঁড়ি
দিয়ে উঠে দোতলায় গেলাম |
সেখানে এই
স্তাপত্যের কাহিনী ও অসাধারণ
ভাস্কর্যের নিদর্শন যত্ন
সহকারে রক্ষিত আছে |
সবই শ্বেত
পাথরের ওপর কাজ |
প্রাচীন
রোমান বোদ্ধাদের আবক্ষ মূর্তি,
ও অন্যান্য
প্রস্তর মূর্তি ,
তাদের
সুক্ষাতিসুক্ষ কারুকার্য
শিল্পীর অসীম অধ্যাবসায় ও
নৈপুন্যের সাক্ষ্য রেখে গেছে
| এবার
আসতে আসতে সিঁড়ি দিয়ে ৩ তলায়
পৌছালাম | সেখানকার
বিশাল গোল ব্যালকনিতে গেলাম
| সেখান
থেকেই হাজার হাজার রোমান জনগণ
নিচে গ্ল্যাডিয়েটর এর খেলা
দেখত ! এখান
থেকে পুরো ampitheatre এর
বিশাল elliptical আকারটা
বোঝা যায় | রোমান
সম্রাট ও তাঁর বিশেষ অতিথি,
মন্ত্রী
আমলাদের বসার জায়গা আলাদা,
এবং তাঁদের
প্রবেশ পথও স্বতন্ত্র |
এই ব্যালকনি
থেকে সুরঙ্গগুলোর ভগ্নাংশ
ও ক্রীড়া - ক্ষেত্র
স্পষ্ট দেখা যায় |
পরিস্কার
বোঝা যায় কোন পথে এই সুরঙ্গ
থেকে পশু ও মানুষ arena
তে প্রবেশ
করত | আমার
চোখে "Gladiator" ছবির
সেই দৃশ্য চোখে ভাসছিল যখন
মাক্সিমাসের দল নির্ভিক
বীরত্বে সিংহ ও সম্রাট পক্ষের
রথীদের সঙ্গে সংঘর্ষ করেছিল
! যেন
চোখের সামনে দেখতে পেলাম প্রায়
২০০০ বছর আগেকার কলিসিউমের
রোমহর্ষক ঘটনা । নিচে arena
তে রক্তাত্ত
গ্ল্যাডিয়েটর এর সাথে সিংহের
লড়াই চলছে । আর হাজার হাজার
দর্শকের কলরব এই বিশাল স্থাপত্যের
দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে
!
ভাবে,
উত্তেজনায়
বিভোর হয়ে অবশেষে কলোসিয়াম
থেকে বেরিয়ে এলাম |
একবার পিছন
ফিরে দেখলাম এই অসাধারণ শিল্প
সৃষ্টির দিকে | যেন
পুরো আকাশকে আপন আলিঙ্গনে
বেঁধে রেখেছে !
পরাক্রমী
রোমান সাম্রাজ্যের অহংকার
বুকে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
আছে এই স্থাপত্য যুগ যুগ ধরে,
কত ঝড় ঝাপটা
মাথায় নিয়ে । ভূমিকম্পে মাথার
খানিকটা অংশ ভেঙ্গে গেছে |
কিন্তু মান
এক চুলো কমেনি ! আজও
এই কলোসিয়াম পৃথিবীর অন্যতম
সেরা শিল্প ও বিস্বয় !
কিন্তু ভাবতে
অবাক লাগে, যে
রোমান সভ্যতা এত মহান কালজয়ী
শিল্পী, পন্ডিত,
জ্ঞানী,
গুনী মানুষের
চারণ ভূমি দিয়েছে,
সেই একই
সভ্যতার মানুষ কি ভাবে এই
রক্তাত্ত বিনাশ লীলায় আনন্দ
খুঁজে পেত ? হে
কলোসিয়াম এত নির্মমতা লুকিয়ে
রেখেছ তোমার গর্ভে ?
কেন তুমি
নির্মল সুন্দর হতে পারনা ?
এত রূপ বাইরে
নিয়ে কেন অন্তরে অন্তরে বিষ
পান কর ? তাই
বুঝি মহান রোমান সাম্রাজ্যের
পতন হলো ? এত
অসহায় মানুষের দক্তের দাম
দিতে নিলাম হয়ে গেল তার মান,
তার সব ঐশ্বর্য
!!
আশে
পাশে Forum তথা
আরও কিছু স্তাপত্যের ভগ্নাবশেষ
ছিল | সেগুলোও
কিছুক্ষণ দেখলাম |
কিন্তু
কলোসিয়াম অনায়াসেই তাদের
সবাইকে ছাপিয়ে গেছে,
নিজ রূপে ,
নিজ গুণে ;
আকারে ও
ঐতিহ্যে !
বিকেল
বিকেল হোটেল ফিরে এলাম,
এই অবিস্বরনীয়
অভিজ্ঞতা বুকে নিয়ে |
এখানে বলে
রাখা ভালো, ইতালিয়ান
পকেটমারির বিশ্বজোড়া খ্যাতি
! তবে
সুখ্যাতি না কুখ্যাতি সেটা
বলা মুশকিল ! আমার
এক স্যার এর মুখে শুনেছি এরা
নাকি পকেটমারিকে রীতিমত
শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে
! ভিড়ের
অবকাশে এদের শৈল্পিক অঙ্গুলি
সঞ্চালনে কখন আপনার পকেটটি
হালকা হয়ে যাবে,
আপনি টেরই
পাবেন না ! এটি
রাগের কারণ অবশ্যই । কিন্তু
মাল খুইয়েও নাকি মনে মনে তাদের
হস্ত শিল্পের তারিফ না করে
থাকা যায়না ! তাই
আমি ওয়ালেট ও মোবাইল হ্যান্ড
বাগের ভেতরে রেখেছিলাম,
বাইরে শুধু
কিছু খুচরো পয়সা ছিল ,
মেট্রো ভাড়া
বাবদ | কাজেই
হস্ত শিল্পীরা তাদের কেরামতি
দেখাবার সুযোগ পায়নি !
(৩)
২৫
শে অক্টোবর, মানে
যেদিন রাতে রোম থেকে ভারতে
ফেরার প্লেন, সেদিন
ভ্যাটিকান সিটি ঘুরতে গেছিলাম
| প্রথমে
ভাবছিলাম যাব কিনা |
কারণ কতক্ষণ
লাগবে দেখতে, সময়ে
ফিরতে পারব কিনা -
এইসব ভেবে
দোনোমোনো করছিলাম |
কিন্তু
অনেকেই যখন বলল “রোমে এসেছ
আর ভ্যাটিকান দেখবে না ?
লোকে হাসবে
যে শুনলে !” তখন
"জয়
মা" বলে
বেরিয়ে পরলাম |
মেট্রো করে
অত্তাভিয়ানো স্টেশন পৌছালাম
| সেখানে
একটু হাঁটা হাঁটি করছি,
এমন সময়
শুনলাম “ভাই সাহাব !
আপ ভ্যাটিকান
দেখনে আয়ে হ্যায় ?
হিন্দুস্তান
সে হো না ?” আমি
পেছন ফিরে দেখলাম ,
এক সুশ্রী
, মার্জিত
চেহারার মাঝ বয়সী ভদ্রলোক
আমাকেই বলছেন |
“জনাব,
উস তরফ নাহি
ইস তরফ যাইয়ে ” বলে যেদিকে
হাঁটছিলাম, তার
ঠিক ৯০ ডিগ্রী বরাবর আরেকটা
রাস্তা দেখিয়ে দিলেন |
বুঝলাম ওনার
কোনো স্বার্থ আছে,
না হলে এত
খাতির কেন ! কথা
বলে জানতাম ভদ্রলোক পাকিস্তানি,
আর একটি
guided tour সংস্থা
“Maya” এর
সাথে যুক্ত | ওনার
সাথে কথা বলে বুঝলাম আমি একা
গেলে টিকেট এর লাইনে অনেকটা
সময় যাবে ! এই
অভিজ্ঞতা কলোসিয়াম দেখতে
গিয়ে হয়েছে ! আর
এখানে কোথায় কি দেখব সেটাও
জানিনা | হাতে
সময় বড় অল্প | আর
এনাদের মাধ্যমে গেলে ২.৫
ঘন্টায় সব দেখা হয়ে যাবে |
টিকিটের
লাইন দিতে হবে না,
আর অনেক তথ্য
পাওয়া যাবে | সব
দেখা বলতে – ভ্যাটিকান মিউসিয়াম,
সিস্টিন
চ্যাপেল এবং সেইন্ট পিটার
বাসিলিকা - এইগুলি
দেখাবেন এনারা |
এইগুলি নাকি
এখানকার মূল আকর্ষণ |
কাজেই “Maaya”
এর বন্ধনে
ধরা দিলাম ৪৫ ইউরোর বিনিময়ে
|
গাইড
মহিলাটি বেশ প্রানবন্ত এবং
রসিক | এবং
ভ্যাটিকান সিটি নিয়ে অনেক
পড়াশোনাও আছে মনে হলো !
ইনি ইংলিশ
ভাষায় ভ্রমণের নির্দেশ দ্যান
| এছাড়া
স্প্যানিশ, জার্মান
প্রভৃতি ভাষায়ও টুর হয় |
সেগুলোর
গাইড আলাদা | আমাদের
গাইড এর পথনির্দেশে আমরা মোট
২৫- ২৬
জন রওনা হলাম ভ্যাটিকান
পরিক্রমায় | প্রথম
গন্তব্য ভ্যাটিকান মিউসিয়াম
বা “Musei Vaticani” | ঢুকেই
আমরা হাতে একটি করে প্রবেশ
টিকেট পেয়ে গেলাম |
আর একটি
ওয়্যারলেস ইআর-ফোন
যাতে করে গাইড মহিলা ধ্রষ্টব্যের
বিষয়ে যা যা কথা বলবেন তা
পরিস্কার শোনা যাবে |
প্রচুর লোকের
ভিড়, আর
একই সাথে অনেক গাইড তাদের
মক্কেল দের জ্ঞান দিচ্ছে |
ওনার কথা
যাতে তার দলের সব্বাই শুনতে
পান তাই এই ব্যবস্থা !
আর এই ভিড়ে
যাতে তাঁকে আমরা হারিয়ে না
ফেলি সেই জন্যে তাঁর হাতে একটি
কালো ছাতা, যেটি
পতাকার মত উঁচিয়ে উনি হেঁটে
চলেন, আর
দূর থেকেও জনসমুদ্রে সেটি
লাইট হাউসের মত আমাদের পথ
দেখায় ! এই
মিউসিয়ামে বহু সময় ধরে রোমান
ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা সযত্নে
রক্ষিত বহু মূল্যবান ও শিল্প
নৈপুন্যে অসাধারণ অনেক জিনিস
রয়েছে | রোমান
সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বহু
দেশের অতুলনীয় শিল্পকর্ম
স্থান পেয়েছে এখানে |
যেমন গ্রীস
এর শ্বেত পাথরের ভাস্কর্য
এবং মিশরের ব্রোঞ্জের কলা
কীর্তি | অর্থাত,
নিজ সাম্রাজ্যের
যে কোনো জিনিস পছন্দ হলেই সেটি
নিজের মনে করে,
সেটিকে তুলে
এনে নিজের ঘরে সাজিয়ে রাখার
শখ সুধু ব্রিটিশদেরী ছিলনা,
তার আরও নজির
রয়েছে ! গ্রীস
এর মূর্তি গুলোর মধ্যে অন্যতম
উল্লেখযোগ্য হলো “Laocoon
and his Sons” | Laocoon হলেন
ট্রয়ের পুরোহিত যিনি ট্রয়বাসীদের
সাবধান করেছিলেন সেই কুখ্যাত
ট্রোজান হর্স এর বিষয়ে |
গ্রিক
সেনাবাহিনী ১০ বছর যুদ্ধের
পর যখন ট্রয় এর দুর্গ ভেদ করতে
পারল না, তখন
তারা এই বিশাল ঘোড়া -
ট্রোজান
হর্স ট্রয় এর দুর্গের বাইরে
রেখে চলে যায় | এই
পুরোহিত মিনতি করেছিলেন ট্রয়
এর রাজাকে , যেন
এই ঘোড়া পুড়িয়ে দেওয়া হয় |
এতে গ্রিকদের
দুরভিসন্ধি রয়েছে !
ট্রয়বাসীরা
তাঁর কথায় আমল না দিয়ে মহা
ফুর্তিতে ঘোড়াটিকে শহরের
ভেতরে নিয়ে যায় |
এই ঘোরার
মধ্যেই লুকিয়ে ছিল একদল রণকুশলী
গ্রিক যোদ্ধা, যারা
রাতের অন্ধকারে ঘোড়া থেকে
বেরিয়ে ট্রয় শহরে আগুন লাগিয়ে
দেয় এবং ভেতর থেকে ট্রয় এর
দুর্গের দুয়ার খুলে দেয় !
গ্রিক সৈন্যদল
রাতের বেলায় ট্রয় প্রবেশ করে
এবং ট্রয় ধ্বংস করে দেয় !
এই মূর্তির
মাহাত্ব হলো,
কিম্বদন্তী
শিল্পী মাইকেলএঞ্জেলো এই
ভাস্কর্য দেখে এমন ভাবে প্রভাবিত
হন যে উনি এই আদলেই সিস্টিন
চ্যাপেলের ছাদে অসাধারণ
ছবিগুলি আঁকেন !
পরবর্তীকালে
এই ছবিগুলি বিশ্ব শিল্পের
ইতিহাসে অমর কীর্তি হয়ে গেছে
! মিশরের
বহু ব্রোঞ্জের মূর্তি,
যেমন হারকুলিস
, স্ফিনিক্স
প্রভৃতি নজর কাড়ে |
মিউসিয়ামটির
স্তাপত্য অসাসারণ,
শিল্পী লুকা
বেল্ত্রামি |
মিউসিয়ামের
একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো,
একটি ঘরের
দুপাশের দেয়ালে ভাগ ভাগ করে
পুরো ইতালির মানচিত্র আঁকা
রয়েছে | এবং
প্রতিটি মানচিত্র সঠিক |
একটি যিশুর
তৈলচিত্র দেখলাম যেটার বৈশিষ্ট
হলো, যে
দিক থেকেই দেখা যাক না কেন ,
সব সময়ই মনে
হবে যিশু আপনার দিকেই তাকিয়ে
আছেন ! আর
মিউসিয়ামের খিলান করা ছাদে
আঁকা তৈলচিত্র ও ভাস্কর্য
অপরূপ সুন্দর !
এর
পর গেলাম সিস্টিন চ্যাপেলের
ভেতর | এরই
সারা ছাদ জুড়ে মহান শিল্পী
মাইকেলএঞ্জেলোর হাতে আঁকা
চিত্র | আগেই
বলেছি Laocoon এর
ভাস্কর্যে মুগ্ধ হয়ে শিল্পী
এই ছবিগুলো আঁকেন |
ভ্যাটিকান
এর বাকি চিত্রগুলো দেখলে বোঝা
যাবে কেন মাইকেলএঞ্জেলোর
আঁকা ছবি গুলো এক্কেবারে
আলাদা | এই
ছবি গুলোয় বেশ তেজস্বী,
পেশীবহুল
পুরুষ দেহ দেখানো হয়েছে |
ঠিক যেমন
“Laacoon and his Sons” এর
ক্ষেত্রে দেখা যায় |
রাফাএল আর
অন্য শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলোতে
পুরুষ দেহে এত দৃপ্ততা দেখানো
হয়নি | এবং
Laocooner এর
ভাস্কর্যের মত এই ছবিগুলো
নগ্ন ! তবে
মাইকেলএঞ্জেলোর ছবিগুলো যেমন
ভাবে মুগ্ধ করে ,
যেমন সৌন্দর্যের
অনুভূতিতে মনকে আপ্লুত করে,
উজ্জীবিত
করে, বাকি
চিত্রগুলো মনে তেমন রেখাপাত
করতে পারে না | তাই
মাইকেলএঞ্জেলো সর্বকালের
অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী !
সিস্টিন
চ্যাপেলে ঢুকতে ডান দিকের
দেয়ালে বিভিন্য শিল্পীর আঁকা
মোসেসের এর চিত্র বা "ফ্রেস্কো"
| অর্থাত
যিশুর জন্মের আগেকার কথা
চিত্রায়িত আছে এখানে |
বাম দিকের
দেয়ালে রয়েছে যিশু কথার চিত্রায়ন
| এবং
উপরে, ছাদে
মাইকেলএঞ্জেলোর ফ্রেস্কো |
“আদম এর জন্ম
” ছবিটিতে মাইকেলএঞ্জেলো
দেখিয়েছেন ঈশ্বর পৃথিবীর আদি
পুরুষ আদমে প্রাণ স্থাপন করছেন
| আরও
অনেক অসাধারণ ছবি রয়েছে যেগুলো
প্রত্যেকটি একটি কাহিনী বয়ান
করে | কিন্তু
সব চেয়ে বিখ্যাত ছবিখানি হলো
“The Last Judgement” | এই
অসাধারণ চিত্রকলায় অমর শিল্পী
জীবন মরণের অদ্ভুত খেলা ব্যক্ত
করেছেন অসাধারণ দক্ষতা ও
কল্পনাশক্তির মাধ্যমে |
এই ছবিতে,
একদিকে যিশু
নতুন প্রানের জন্ম দিচ্ছেন,
আবার অন্য
দিকে তাদের প্রাণ হরণ করছেন
| দুষ্টরা
দলে দলে নরকে নিপতিত হচ্ছে |
এবং মানুষের
অনাবিল সুখ ও মিলনের ছবিও ফুটে
উঠেছে প্রাঞ্জল হয়ে |
এই ছবি দেখলে
গায়ে রীতিমত কাঁটা দেয় !
যেন জীবন
বোধের প্রতিটি রসে,
প্রতিটি
রূপে চেতনা পূর্ণতা লাভ করে
| শোনা
যায় মাইকেলএঞ্জেলো ভাস্কর
শিল্পী ছিলেন, ছবি
আঁকা পছন্দ করতেন না |
পোপ পল III
এর অনুরোধে
বহু অনিচ্ছা সত্তেও সিস্টিন
চ্যাপেলের ছাদে ছবি আঁকতে
সম্মত হন | ঐশী
শিল্প রচনায় তন্ময় শিল্পী
প্রায় ৪ বছর ধরে একা হাতে এত
ছবি এঁকেছিলেন !
ওপরে তাকিয়ে
ছবি আঁকতে আঁকতে রঙের বিষাক্ত
কেমিকাল শিল্পীর চোখে পড়তে
থাকে | ফলে
শেষ বয়সে তিনি অন্ধ হয়ে যান
! মনে
মনে মহান শিল্পীকে হৃদয়ের
অর্ঘ্য নিবেদন করে সিস্টিন
চ্যাপেল থেকে বেরোলাম |
অবশেষে
সেইন্ট পিটার বাসিলিকা । এটি
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত ক্যাথলিক
চার্চ এবং শিল্প সম্পদে অনবদ্য
| এইটির
রুপাযনেও মাইকেলএঞ্জেলোর
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে
| এটির
নামকরণ করা হয় সেইন্ট পিটারের
নামে যিনি হলেন ইতিহাসের প্রথম
পোপ | এখানেই
সেইন্ট পিটারের কবরটি অবস্থিত
| রেনেসা
যুগের অন্যতম শ্রেষ্ট শিল্পকীর্তির
সাক্ষ্য বহন করে রয়েছে এই
স্থাপত্য | মাইকেলএঞ্জেলো
এবং বহু মহান শিল্পীর শ্বেত
পাথরের ভাস্কর্য মুগ্ধ করে
বার বার ! এই
বাসিলিকা, তার
সামনে বিশাল গোল প্রান্তর
যার কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল
ওবেলিস্ক – এগুলি একসাথে "St
. Peter’s Square" বা
"St. Peter’s Piazza " নামে
বিশ্বখ্যাত | রোজ
এখানে দেশ বিদেশ থেকে শয়ে শয়ে
লোক আসেন এই চূড়ান্ত শিল্পকীর্তির
দর্শন লাভ করতে |
অবশ্য ক্যাথলিক
খ্রীষ্টানদের কাছে এটি
তীর্থক্ষেত্রও বটে |
আপন গরিমায়
এবং শিল্পের উত্কর্ষে ভ্যাটিকান
সিটি অনন্ত মহিমার মূর্ত
প্রতীক | এটি
শিল্প ও সৌন্দর্যপ্রেমী
মানুষের স্বপ্নের স্বর্গধাম,
পরম দর্শনসুখ
ও তৃপ্তির পীঠস্থান |
আবার
মুগ্ধ হয়ে মেট্রো করে আমার
হোটেল পৌছালাম |
কলোসিয়াম
আর ভাটিকানের উজ্জল ছবি মনের
পটে এঁকে স্বদেশ পাড়ি দিলাম
| হে
সুন্দর রোম, আদ্দিও
!