Wednesday 21 July 2021

পথে হয়েছিল দেরি

তখন আমার ২১ বছর বোধহয় (তোমার কত জানিনা, কারণ তোমাকে তখনও চিনিনা) । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি । বাড়ি থেকে রোজ সকালে (শনি-রবি বাদে) দু গ্রাস নাকে মুখে গুঁজে সকাল ৮:৩০ নাগাদ ছুটতে হতো নতুন রাস্তা বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরবো বলে । বাস আর বাঁশ শব্দের পার্থক্য এতই সুক্ষ যে অনেক সময় তা ধরা যায়না, তখন সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান হয় । বৃষ্টির দিন । তার মানেই বাস কম । চোখের সামনে দিয়ে একটা বেরিয়ে গেল, ওঠা গেলো না । কারণ তার দরজায় অগণিত যাত্রী ঝুলছেন, ভেতরের অবস্থা আর বললাম না । আমার অবশ্য ভেতরের খবরে আগ্রহ ছিল না । আমি চিরকালই নির্বিবাদী বনবাসী পাণ্ডবদের মতো স্বল্পেই খুশি । বাসের প্রথম পা-দানিতে একটা পা আর কোনো রকমে ঝোলার জন্যে দুটো ধরার জায়গা হলেই আমি খুশি । পরের বাসেও ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো না । তৃতীয় বাসে উঠতেই হবে নাহলে AK স্যারের ক্লাসে ঢুকতে দেরি হয়ে যাবে, আর পরে ওনাকে অনেক জবাবদিহি করতে হবে, সে এক বিভীষিকাময় ব্যাপার !! তাই "জয় মা" বলে পরের বাসে ঝুলে পড়লাম । এক পা নিচ থেকে প্রথম পাদানিতে, একটা হাত বাম রডে, দ্বিতীয় হাত যেখানে সুবিধা সেখানে । এই ভাবে চলতো জীবন সংগ্রাম প্রতি প্যাসেন্জারের ওঠা-নামার সময়, বাসের ব্রেক কষার সময়, বাম্পার ইত্যাদিতে । পাশ দিয়ে হুশ হাশ করে গাড়ি বাইক বেরিয়ে যাচ্ছে । ভগ ভগ করে কালো ধোঁয়া তখন অঙ্গের বসন, পোঁ পাঁ হর্ণের শব্দ কানের অলংকার । প্রায় দেখা যেত আমি আর কন্ডাকটর একই পাদানিতে । বাস একটু থামলে জানলা থেকে এক সহৃদয় ভদ্রমহিলা বললেন "তোমার ব্যাগটা ধরবো ভাই?"। বলাই হয়নি পিঠে একটা গোদা ব্যাগ থাকত, তাতে ক্লাস নোটের বহুমূল্যবান খাতা, টিফিন বাক্স আরও কত কি । উটের কুঁজের মতো তা আমার প্রায় শরীরের অংশ হয়ে যেতো এই সংগ্রামের সময় । আমি রাজি হওয়ার সাথে সাথেই আমার পীঠ থেকে থেকে কয়েক হাত হয়ে ব্যাগ পৌঁছে গেলো সেই মমতাময়ীর কোলে । হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো । হাওয়া দিলে বৃষ্টি বাঁক খেয়ে আমার চোখে মুখে এসে পড়তো পাহাড়ি ঝর্ণার মতো। বাস যখন দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজে উঠতো গঙ্গার হাওয়া ভেজা চোখে মুখে মোয়ালেম আদর বুলিয়ে যেত । চোখ বুজে আসতো । তখন আমি পাদানিতে । কিন্তু এই মধুর আবেশে নিজেকে টাইটানিকের জ্যাক মনে হতো । যদি দুহাত মেলে দিতে পারতাম পাখির মতো । আর সামনে থাকতো .. আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলাম কাক-ভেজা রাগত চেহারার কন্ডাকটর "বাস খালি, বাস পুরো খালি, পেছন দিকে এগিয়ে চলুন. ." এর মতো ডাহা মিথ্যে কথাগুলো অম্লান বদনে আউড়ে যাচ্ছে, তখন সুখ কল্পনায় পূর্ণচ্ছেদ পড়লো । ব্রিজ থেকে নেমে পরের স্টপেজে স্থানচ্যুত হতে হলো । কারণ অগণিত প্যাসেঞ্জের বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো নেমে এলো দরজা বেয়ে । কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখা যেত মোটে ১-২ জন নামতেন, বাকিরা আবার হৈ হৈ করে বাসে ওঠার লড়াইয়ে সামিল হতেন । এবারেও তাই হলো । ইতি মধ্যে বাস ছেড়ে দিলো । লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকারা প্রাণপণে দৌড়োলেন বাসের পেছনে । আমিও দৌড়লাম ব্যাগের মায়ায় । আমি আবার দরজা বেয়ে ওঠায় সফল হয়ে দেখলাম আমার ব্যাগ ঠিকই রয়েছে, কিন্তু মহিলাটি বদলে গেছেন । রবীন্দ্র সদনে নেমে এবার মেট্রোর লাইন । তখনও স্মার্ট কার্ড করাইনি । শুনছিলাম কয়েকটা মেট্রো স্টেশনের নাম বদলে স্বনামধন্য ব্যক্তিদের নামে হবে । যেমন টালিগঞ্জ নাকি হবে মহানায়ক উত্তম কুমার । ভাবতাম কেউ বলবেন "দুটো মহানায়ক উত্তম কুমার দেবেন তো" ! ইতি মধ্যে আমি টিকিট কাউন্টারে পৌঁছে গেছি । বললাম "একটা রবীন্দ্রনাথ,.. থুড়ি, রবীন্দ্র সরোবর" । রবীন্দ্র সদন মেট্রোয় রবিঠাকুরের কত কবিতা, হাতের লেখা, আঁকা চিত্রায়িত । কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় হলে "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত", শক্তি চট্টোপাধ্যায় হলে "অবনী বাড়ি আছো" এসব লেখা থাকতো । কিন্তু এর চিত্ররূপ কেমন হতো ভাবছি এমন সময় দেখি মেট্রো এসে গেছে । এই মানুষ-পেষা ভিড়ে তাড়াতাড়ি ওঠার কায়দা রপ্ত না করলে বিপদ । সোজা সুজি ওঠা যাবে না, তাহলেই পিল পিল করে নামা প্যাসেঞ্জেরদের সাথে সামনা সামনি ধাক্কা লাগবে । আবার সবার নামার অপেক্ষা করলেও মেট্রো ছেড়ে দেবে । "ডীস্কো ডান্সার" ছবির মিঠুনদার মতো কোমর বেঁকিয়ে তেরচা হয়ে দরজার প্রান্ত এড়িয়ে উঠে পড়তে হতো । এই সময় মেট্রোয় এমন ভিড় হতো যে কিছু না ধরেই দিব্বি সোজা হয়ে দাঁড়ানো যেত । উঠেই ভাবছিলাম জীবনানন্দ দাসের নামে মেট্রো স্টেশন হলে লোকে টিকিট কাউন্টারে কি বলতো ? "তিনটে জীবনানন্দ দেবেন " ! সত্যি যদি তিনটে জীবনানন্দ দাস থাকতেন তাহলে "বনলতা সেন" কজন থাকতো ? একজনই কি তবে তিন হাজার বছর ধরে পথ হাঁটতেন? নাকি ৩জন আলাদা আলাদা করে হাজার বছর করে পথ হাঁটতেন । হেঁটে এসে দেখতেন কফি কাউসের টেবিলে বসে আছেন মিস সেন । পথিক বলতেন "সরি ম্যাডাম, আপনার ডায়লগ ছিল না ? ... 'এতদিন কোথায় ছিলেন?' " তিনি বলতেন "এই যে একটু আগেই বললাম, আবার বলতে হবে ?...আপনি কি আবার এক নম্বর ?" "না না আমি তো ২ নম্বর। . আসলে শুরু করতে দেরি করেছিলাম কিনা! তারপর দেখি শ্রাবস্তী বলে আর কিছু নেই । তাই নতুন লোকেশন দেখে আসতে দেরি হলো । আপনি কি ১ নম্বর ?" "হ্যাঁ " "২ নম্বর কই? আমার তো তাঁর সাথেই .." "তার আসতে একটু দেরি হবে। আপনাদের কি ধারণা আমরা আপনাদের জন্যে ঠাঁয় বসেই থাকি। আর কোনো কাজ নেই আমাদের? সেই সক্কাল সক্কাল রান্না বান্না সেরে, এই বৃষ্টিতে অটো মেট্রো ঠেঙিয়ে আসতে হয়েছে, ছাতাটা আবার ছেঁড়া ! চোখের কাজলটাও গেলো ধেবড়ে !" "কি দাদা নামবেন নাকি ?" চমক ভাঙল, দেখি সেই ভীড় মেট্রো । ভাবলাম দাদা নামতে তো হবেই, আজীবন তো মেট্রোয় কাটানো যায়না ! মুখে বললাম "আগে না " "তাহলে সরে দাঁড়ান না, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেন?" জায়গা ছেড়ে যখন একটা সিটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি দেখি এক কাজল নয়না ড্যাব ড্যাব করে আমার পানেই চেয়ে আছে । মুখে মিটি মিটি হাসি । ভাবলাম, পাখির নীড়ের মতো চোখ ! বাঃ ! .. কিন্তু এ কি ২নম্বর, নাকি ৩?...আমি তাহলে কত নম্বর ?? মেয়েটি কি হাজার বছর ধরে এইভাবেই বসে আছে ? আহা !! ভাবতে ভাবতে দেখলাম পরের স্টেশন এলো । চোখের সামনে মেয়েটি নেমে গেলো । রবীন্দ্র সরোবর । মেয়েটি ফিরে তাকালো কি ? ভিড়ের মধ্যে বুঝতে পারলাম না । যা! দু দণ্ড শান্তি পাওয়া হলো না ! কিন্তু আমি বেশ কোথায় নামতাম ? দারুচিনি দ্বীপ ? নাকি, নাকি রবীন্দ্র সরোবর!! এই রোককে রোককে । কে কার কথা শোনে ! পরের স্টেশন টালিগঞ্জ, তাতেই নামলাম অগত্যা । ভবিষতের মহানায়ক উত্তম কুমার । মনে পড়লো উত্তম বাবুর এক ছবির নাম "পথে হলো দেরি "। -- কৃপা

No comments:

Post a Comment