Sunday 22 November 2020

খোশগল্প

 (১) কাকতালীয়?


ব্যোমকেশ বকশীর নাম শোনেননি এমন বাঙালী বিরল । শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট অমর চরিত্র ব্যোমকেশ, যাঁকে প্রথম পাই  'সত্যান্বেষী' গল্পে যা প্রকাশিত হয় সম্ভবত ১৯৩২ সালে ।  কিন্তু জটাধর বকশীর নাম কজন শুনেছেন ? পরশুরাম (রাজশেখর বসু) সৃষ্ট এই চরিত্রের প্রথম আত্মপ্রকাশ সম্ভবত ১৯৫২ সালে । জটাধর এক ঠগ এবং গুলবাজ । অথচ গল্পের গুণে তার প্রতি সম্ভ্রম জন্মানো খুবই স্বাভাবিক । এখানে শরদিন্দু বাবুর অন্য এক চরিত্রের কথা মনে পড়ে -- বরদা, যদিও তাকে ঠগ বলা যায়না, বরং তাকে সুপটু গুলবাজ বলাই ভালো (অনেকটা প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার মতো) । ভালো কথা, ঠগ ও গুলবাজের পথ্যে একটি পার্থক্য রয়েছে । ঠগের কার্যকলাপ সাধারণত অর্থলাভের মতো বৈষয়িক স্বার্থের  জন্যে ('চাঙ্গায়নী  সুধা' গল্পে জটাধর যা করেছিল)। অন্যদিকে গুলবাজ সাধারণত মিথ্যাচার করে কিছু শ্রোতাদের অলীক অথচ চমকপ্রদ কল্পনায় মজিয়ে তাদের কাছে নিজেকে মাতব্বর প্রমাণ  করার জন্যে ।  জটাধর আর বরদার গল্পে আড্ডার আসর বসতো  চা জলখাবারের দোকানে, মেস ক্লাব বা বাড়ির বৈঠক খানায় (যেমনটা ঘনাদা, তারিণী খুড়োর গল্পেও দেখি )। 

এখানে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন কি ? দুটো নাম   -- ব্যোমকেশ বকশী এবং জটাধর বকশী । ব্যোমকেশ ও জটাধর দুটিই মহাদেবের নাম ! জটাধরের চরিত্র অনেকটা ব্যোমকেশ স্রষ্টার অন্য এক চরিত্র বরদার মতো । 

না ! পরশুরাম (রাজশেখর বাবু) সৃষ্ট তেমন জবরদস্ত গোয়েন্দা চরিত্র চোখে পরে না । তবে সরলক্ষ হোম নামক এক শখের গোয়েন্দার উল্লেখ মেলে তাঁর এক গল্পে । 'নীলতারা' গল্পে তো স্বয়ং শার্লক হোমসকে হাজির করেছেন !

শরদিন্দু ও রাজশেখর বাবুর ব্যক্তিগত জীবনেও কিছু মিল পাওয়া যায়, যথা 
১) দুজনেই আইন পাস করেন ।
২) বিহার প্রদেশের (মুঙ্গের, পাটনা) সাথে দুজনেরই নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ।
৩) শরদিন্দু বাবুর  জন্ম সাল ১৮৯৯ যেবছর রাজশেখর বাবু বি.এ. পাস করেন । 
৪) দুজনেরই জন্ম মার্চ মাসে ।

এছাড়া দুজনেরই অনেক গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক  হয়েছে । শরদিন্দু বাবু তো বেশ কিছুদিন বোম্বেতে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার কাজ করেন ।

পুনশ্চ: রাজশেখর বাবু ও শরদিন্দু বাবু বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যের দুই মহীরুহ । আমি দুজনেরই গুণমুগ্ধ ভক্ত । এই অদ্ভুত কাকতালীয় যোগাযোগ দুজনের মধ্যে কিভাবে ঘটলো তা ভাবে কূল পাচ্ছিনা । তাই এই আশ্চর্য observation আপনাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিলাম । আর যদি মনে হয় আমি এনাদের তুলনা বা সমালোচনা করছি, তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী । কস্মিনকালেও সেটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না । এই ধৃষ্টতা করার যোগ্যতা আমার নেই । এখানে  'great men think alike' এই বিখ্যাত উক্তিটি  হয়তো প্রযোজ্য । এটাও হয়তো বলা যায় 'great men are alike'।  এই যাহঃ ! মহিলারা আবার রাগ করলেন নাকি?

(২) যেমন কাম তেমন নাম 

আমাদের বাড়িতে একজন কিছুদিন মিনারেল ওয়াটার দিতো । তার নাম বরুণ (হিন্দু  মতে জলের দেবতা) । 'অনির্বাণ গ্যাস এজেন্সী' থেকে আমরা ইনডেনের সিলিন্ডার পাই । এজেন্সির ট্যাগলাইন যেন -- "অনির্বাণ শিখা  জ্বলুক ওভেনে ওভেনে" । যাঁরা এদের নাম দিয়েছেন তাঁদের দূরদৃষ্টির তারিফ না করে পারছি না !

এগুলো কাকতালীয় হলেও পদবি পেশার সাথে মিলিয়ে রাখার প্রথা কিন্তু বেশ পুরনো  । সম্ভবত বিশ্বেজুড়ে  ব্রিটিশ শাসনকালে এমন প্রথার প্রচলন ঘটে । পারসী সমাজে 'ওয়ালা' পদবি সম্ভবত ইংরেজ আমলে দেখা যায় ।  যেমন বোতলের  কারবারি হলেন বাটলিওয়ালা , ওষুধের ব্যবসায়ী দারুয়ালা (তখন ওষুধকে 'দারু' বলার প্রচলন ছিল!), টায়ারের ব্যবসায়ী টায়ারওয়ালা, নারকেল ব্যবসায়ী হলেন নারয়েলওয়ালা প্রভৃতি । তাছাড়া 'vakil' (পুণেতে Dr. Vakil নামক দাঁতের ডাক্তারের চেম্বার দেখেছি), ইঞ্জিনিয়ার (ক্রিকেটার ফারুক ইঞ্জিনিয়ার), মুন্সী প্রভৃতি পদবিও রয়েছে । ইংল্যান্ডে স্মিথ (goldsmith, blacksmith প্রভৃতি থেকে) , tailor/taylor,  বেকার, কুক, শেফার্ড, কার্পেন্টার, clark/clarke (clerk থেকে),  বন্ড (দাস), পার্কার (পার্ক-এর দ্বয়িত্বে যিনি),  ওয়ার্নার (warriner থেকে -- warriner হলেন খরগোশ পালক), bailley (bailiff  থেকে -- bailiff হলেন এক ধরণের কর্মচারী), বিশপ, পোপ  প্রভৃতি পদবি দেখা যায়  যা সম্ভবত ব্রিটিশ উপনিবেশের ফলে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে । একই ভাবে জার্মানিতেও এর প্রচলন দেখা যায় । স্মিথ (smith) এর জার্মান সংস্করণ হলো Schimdt, tailor এর হলো Schneider, baker এর becker। এছাড়া  fisherman দের  fischer, shoemaker দের  schumacher, রাজসভাসদদের hoffmann, খনির শ্রমিকদের bergmann প্রভৃতি রয়েছে । ফরাসিদের মধ্যে boucher (কসাই), পেজ (ভৃত্য) প্রভৃতি আছে । ইহুদিদের মধ্যে cohen পদবীর উৎস তাদের পরিবারের পুরোহিত পেশা । ওলন্দাজ পদবি 'de kock' এর অর্থ cook বা রাঁধুনি, 'de Smet' বা 'de Smedt' এর অর্থ smith ।

বাঙালিদের ও বাংলা সংলগ্ন প্রদেশের লোকজনের  মধ্যেও এর চল রয়েছে । যেমন বণিক, সেনাপতি, ঘটক, গায়েন, মাঝি, পাল, মালাকার  প্রভৃতি । 

Ali Al-Khimay নামের অর্থ নাকি "Ali The Chemist" । অর্থাৎ al শব্দ (এখানে যার অর্থ সম্ভবত 'the') পেশার যুক্ত হতে দেখা যায়, যদিও সব ক্ষেত্রে এমনটি হয়না  । শোনা যায় Alchemy শব্দটি এই ভাবেই এসেছে ।

Friday 23 October 2020

স্বপ্ন

 (১)


আমার জন্মের সময়েই মা চলে গেলো বলে আমার নাম 'অপয়া' । যত বড়ো  হয়েছি আরও কত নাম যে কুড়িয়েছি -- বেয়াড়া, বেয়াদব, অকাল কুষ্মান্ড, কুলাঙ্গার -- তার হিসেব নেই । তাই আর আসল নাম নিয়ে মাথা ঘামাই না ।

ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু অন্য রকম । আর পাঁচটা 'ভালো ছেলে'-এর মতো নই । একটা ঘর ছিল আমার -- তাতে নিজের খেয়ালের জাল বুনতাম, এলোমেলো, অগোছালো ছন্দে । সেই ঘরের নাম দিয়েছিলাম 'মন' (জানি সেটাকে ওরা বলতো 'উচ্ছন্ন')।  ভালোবেসে বাবা আমায় একটা গিটার দিয়েছিলো । তাতেই গুন্ গুন্ করে সুর ভাঁজতাম  । ওই একটা বিষয়েই মন ছিল আমার । পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না । কিন্তু তাতে তেমন আগ্রহ ছিল না ।
শুনেছি মা নাকি খুব ভালো গান গাইতো । গানের মাস্টার বলেছিলো নাকি আমার হবে । কিন্তু হওয়ার আগেই আমার নতুন মা তাকে বিদেয় করলো । 

বারান্দায় অনেক পাখি আসতো -- মৌটুসী, দোয়েল, বুলবুলি, বেনেবৌ, ময়না, ফিঙ্গে  -- আরও কত কি । আমাদের বাড়িতেই একটা বাগান ছিল কিনা, তাই আসতো তারা । শুধু তারাই বুঝতো আমায়, আমি তাদের । তাদের কিচিমিচিতে গানের কথা  খুঁজে পেতাম । আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা । সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতে দেখতাম, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত । আর দেখতাম মুহুর্মুহু বদলে যাওয়া পৃথিবীটাকে । রামধনুর সাত রঙে সাত সুর খুঁজে পেতাম । রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তারাদের মিটিমিটি মর্স কোড ডিক্রিপ্ট করতাম, ব্রম্ভান্ডের কত রহস্য জেনে ফেলতাম চুপিচুপি । জোনাকীর নিয়ন-নৃত্যে  বিভোর হতাম  । ভোরে শিশির ভেজা ফুলে ভ্রমরের সিম্ফনি শুনতাম চোখ বন্ধ করে।


(২)

সেবার গ্রামে দেশের বাড়ির  দূর্গা পুজোয় গেছিলাম । তখন কলেজে পড়ি  । বাতাসে ঢাকের বোল মনে তরঙ্গের  সঞ্চার করছিলো । তবে আমি তেমন মিশুকে নই । তেমন একটা বেরোতাম না । আর কেউ তেমন একটা ডাকতোও না আমায় । ঘর, বারান্দা থেকেই পুজোর আমেজটাকে আত্মস্থ করতাম । 

একদিন চিলেকোঠায় গিটার নিয়ে নতুন গানটা  শেষ করছি । হঠাৎ নূপুরের  মতো সুরেলা কণ্ঠ শুনে ঘোর কাটিয়ে দেখি সে ! কতক্ষণ সে এসে দাঁড়িয়েছে জানিনা । এর আগে তাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লো না 
"বাহ্! এটা তো আগে শুনিনি ! তোমার বানানো বুঝি ?" 
বলে সে চুপটি করে বসে পড়লো আমার পাশে । 
"পুরোটা শোনাও না প্লিস !" 

এক লহমায় অচেনার জড়তা চুরমার করে কেউ এমন কাজ করতে পারে দেখে রীতিমতো অবাক হলাম । তারপর কিছুক্ষণ ভেবে প্রথম থেকে গানটা গেয়ে শোনালাম । চোখ বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো সে । এমন শ্রোতা এর আগে জোটেনি আমার । তার উপস্থিতি যেন এক মায়াময় সংগীত আবহাওয়া তৈরী করতো আমার মনে । তাই সেদিন তার নাম দিয়েছিলাম 'মায়া' । পরে অবশ্য ভাবতাম সে  'আলেয়া' । তারও পরে বুঝেছিলাম, ভুল করেছিলাম । 

চিলেকোঠা থেকে ওঠা নামার অন্য একটা পথ ছিল ।  ভাঁড়ার ঘর হয়ে । সেই পথে আসতো সে,  সন্ধ্যে হলে ।  এ পথের সন্ধান সে কি করে  জেনেছিলো কে জানে ! আমায় চুপিচুপি নিয়ে চলে যেত গ্রামের প্রান্তে সেই কাশ বনটা পেরিয়ে, সেই শিউলিতলায় । কাছেই একটা পুকুর ছিল । তার পারেও যেতাম মাঝে মাঝে । সঙ্গে নিতাম আমার গিটারটা । আকাশ, চাঁদ, শিউলির সুবাস আর আমার গান । চোখ বুজে শুনতো মায়া ।  

সেই একবারই  কেমন যেন অস্থির হয়েছিল সে । আমায় জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলো । বলেছিলো 
"আর বোধ হয় দেখা হবে না ..!!" 
ভারি ছেলেমানুষ সে। ভারি ইমোশনাল, বেহিসেবী হয়ে পড়েছিল সেবার ।    

সেই সন্ধ্যেয় শেষবার দেখেছিলাম তাকে । বলেছিলো "আমায় মনে রেখো .. তোমার গানে গানে" । কাশ, শিউলি সাক্ষি ছিল সেদিন। শুনেছিল আকাশের চাঁদ তারা । পরে জেনেছিলাম তার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে । মায়া যেন আলেয়া হয়ে বিলীন হয়ে গেলো আমার জীবন থেকে । নিজেকে যন্ত্রণা দিয়েছিলাম, শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম নিজেকে । হাতের নাড়ি বয়ে প্রাণ বেরিয়ে যেত আর একটু হলেই, বাবা এসে না পড়লে ! সেই ক্ষত এখনো আছে মনে, তার দাগ হাতে । তার নাম দিয়েছি 'স্মৃতি' । যতবার হাতের দিকে দেখতাম কানে বাজতো  "আমায় মনে রেখো .. তোমার গানে গানে " ।

(৩)

কতদিন কেটে গেছে । ৮ বছর ? আজ চতুর্থী । সন্ধেবেলায় একাডেমিতে আমার অনুষ্ঠান । শারদীয়া সংগীতানুষ্ঠান । ফুল হাউস । বেশ জমাটি অনুষ্ঠান হলো । 'জোনাকীর jazz', 'ভ্রমরের সিম্ফনি', 'শিশিরের সুর', 'পলাশের ঘুম' -- এগুলো দুবার করে গাইতে হলো । শ্রোতারা শেষের দিকে গলা মেলালেন । শেষে অগণিত অটোগ্রাফ-সেলফির আবদার । সঙ্গে কয়েকটা বাংলা নিউস চ্যানেলের সাংবাদিকরা । এসব আমার একদম ভালো লাগেনা ।  কিন্তু কি আর করার !

এতো কিছু সেরে  ব্যাক স্টেজে গিয়ে দেখি আলেয়া ! নাকি মায়া? সঙ্গে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে । সেই চেনা কণ্ঠস্বর (একটু ভারী হয়েছে কি ?)
'আমার ছেলে । ও তোমার খুব ভক্ত ।' 
ওর চোখে সেই মায়া তখনো জেগে আছে । 
'ওর নাম রেখেছি স্বপ্ন । ভারী সুন্দর গানের গলা জানো ।'

বলে আমার চোখের দিকে সেই শেষ দিনের মতন করে চেয়ে রইলো সে । মুহূর্তে সেই স্মৃতি  প্রাঞ্জল হয়ে উঠলো । চিলেকোঠা, কাশ, শিউলি, পুজো ...! আমি সব মনে রেখেছি, গানে গানে । যেমনটি সে চেয়েছিলো । এতো গানে -- তাদের সুরে, কথায়, অভিব্যক্তিতে -- তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে আছে । সেই ক্ষত আজও জেগে আছে আমার মনে -- অদম্য অনুপ্রেরণার আগুন হয়ে । মায়া যে আলেয়াও সে । সুখের মতোই সে ক্ষণস্থায়ী । তবু তার আবেশ রয়ে যায় আমরণ ।

জানলাম তার স্বামী এ শহরেই চাকরি করে । রাস্তার ধারে হোর্ডিং -এ আমার অনুষ্ঠানের খবর পেয়েছে এসেছে । ভালো বিয়ে হয়েছে তার । কিন্তু আমায় কি ভুলতে পেরেছে সে ? তার নীরব চাহনি যেন হাজার বছরের না বলা ইতিহাস ব্যক্ত করছে । 
ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো 
'ওকে শেখাবে? ওর বয়স বয়স ৭।'

কিছুক্ষণ ওর দিকে চাইলাম  অবাক হয়ে । ঠিক যেমন অবাক হয়েছিলাম সেই প্রথম দিন । তারপর ছেলেটির দিকে চাইলাম । তার নিষ্পাপ চোখে কি জানি দেখলাম । স্বপ্ন ? তাই হবে! মুখে তার অনাবীল হাসি । আর সেই মায়া -- যা আমায় জিইয়ে রেখেছে এতদিন !

স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।  এ স্বপ্ন যেন আমারও ।

 'কাশের দেশ', 'শিউলির সাধ', 'মেঘের বিদ্যুৎ' আরও কত কিছু শেখালাম তাকে ।   দেখলাম সেও পাখির ভাষা বোঝে, ভ্রমরের সুর চেনে ।  চেনে রামধনুর রঙে সাত সুর ।  

--

কৃপা 

Saturday 26 September 2020

কোভিডমাঝে অমরাবতী

করোনার দাবানলে বিশ্ব সন্ত্রস্ত। এর আঁচ সমগ্র মানবজাতিকে স্পর্শ করেছে। কেউ নিজে আক্রান্ত, কারো আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু। কেউ আক্রমণের ভয়ে সন্ত্রস্ত। আবার কেউ এই দুর্ধর্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্রতী। স্বাস্থকর্মী, পুলিশ প্রভৃতি  ঈশ্বরের প্রতিনিধিরা এই দুর্বিনীত মহাশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মানুষের কল্যাণে, নিজের জীবন বিপন্ন করে । তেমনই চিত্র এক সরকারী হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে । পিপিই-বর্ম পরে অসংখ্য ডাক্তার, নার্স স্বাস্থ্যকর্মী ততোধিক রোগীর সেবায় আত্মনিয়োজিত প্রাণ। 


ডঃ রিয়া বসু । এই সরকারী হাসপাতাল থেকেই সম্প্রতি সম্মানের সাথে এম.বি.বি.এস পাস করেছে । ভালো কোনো জায়গা থেকে এম.ডি. করার ইচ্ছে । কিন্তু এই পরিস্থিতি তাতে বাধ সেধেছে । এই কলেজ-হাসপাতালের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভারী প্রিয় রিয়া । তাই কোভিড ওয়ার্ডে এই সংগ্রামের ডাক সে উপেক্ষা করতে পারে নি । তা ছাড়াও আর্তের কষ্টে চিরকালই তার প্রাণ কাঁদে । হয়তো সেই জন্যেই রিয়া ডাক্তারী পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় । কৃতী ছাত্রী হওয়ায় সে পথও সুগম হয়েছে ।


এই ওয়ার্ডে কয়েকজন রোগীর ভার পড়েছে রিয়ার ওপর । তাদের মধ্যে অন্যতম স্বপ্নময় মিত্র । দিল্লি আই.আই.টি থেকে পিএইচডি করার পর আমেরিকায় পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করছিলো । অসামান্য মেধাবী ছাত্র হওয়া ছাড়া স্বপ্নময়ের একটি মহৎ গুণ ছিল । সে ছিল মানব-দরদী । মানুষের বিপদ দেখলেই সে আর স্থির থাকতে পারে না । এবারেও তাই হলো । করোনার আগ্রাসনে বিপন্ন আমেরিকা থেকে ফিরেই সে দেশের মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করলো । তারপর এলো আমফানের বজ্রথাবা । ত্রাণ সংগ্রহ এবং বিতরণের কাজে মজে গেলো স্বপ্নময় । কিন্তু করোনা নির্মম, বিবেকহীন । সাধু-অসাধুর তফাৎ করেনা, রেয়াত করেনা । হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর, স্বাস কষ্টের ঢেউ তাকে আছড়ে ফেললো এই কোভিড ওয়ার্ডে ।


রিয়া অবশ্য স্বপ্নময়ের ব্যাপারে কিছুই জানে না । তার কাছে স্বপ্নময় আর একজন রোগী মাত্র । তবুও প্রথমবার স্বপ্নময়ের কষ্টে ম্লান মুখখানি দেখে মায়া হয়েছিল তার । মায়া অবশ্য রিয়ার অসুস্থ মানুষ দেখলেই হয় । কিন্তু এই মায়া বোধ হয় একটু অন্য রকম । কেন ? তা রিয়া বোধ হয় জানে না ।


একদিন স্বপ্নময়ের খুব জ্বর । ঘোরে ভুল বকছে

'মা ... মা ভালো আছে ? মা ..'


স্বপ্নময়ের মা-ই তার একমাত্র আশ্রয় । বেশ কিছুদিন হলো বাবাকে হারিয়েছে সে । মায়ের কোভিড টেস্ট নেগেটিভ । তাও তাঁকে সেলফ ক্যাণ্টিনে রাখা হয়েছে ।


রিয়া তখন স্বপ্নময়ের পাশে, সে বলে


'আপনার মা ভালো আছেন ..আপনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন ..ওনাকে দেখতে পাবেন '


স্বপ্নময় বলতে থাকে


'তপন ..বাপ্পা .. সুন্দরবনে ফুড প্যাকেট পাঠিয়েছে? ..ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার করা হলো না। ...টাকা জোগাড় কি করতে পারবে ওরা ?'


বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো স্বপ্নময় । কথাগুলো দাগ কাটলো রিয়ার মনে ।


একমাসের ওপর হলো রিয়া বাড়ি ফেরেনি । সে তার কলিগ ললিতার সাথে হাসপাতালের কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকছে এ কদিন । রান্না বান্না তারাই কোনোরকমে করে চালাচ্ছে । কোনো কোনোদিন এমার্জেন্সি থাকলে হাসপাতালেই থেকে যেতে হয় । রিয়ার মা নেই, শৈশবেই গত হয়েছেন । বাবা আর বিয়ে করেননি । রিয়ার এক দাদা আছে । রক্তিম । ডাক নাম রুকু । সে লন্ডন-এ সেটলড । বাড়ি থেকে রিয়ার বিয়ের চিন্তা ভাবনা চলছিল । রিয়ার বাবার এক বাল্যবন্ধু অম্লান রায় । মস্ত ব্যবসাদার, কোটিপতি । তাঁর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে রিয়ার বাবার সাথে কথা বলেছেন তিনি । এক ফ্যামিলি ফাঙ্কশন এ তাঁরা রিয়াকে দেখেন । রিয়া বেশ সুশ্রী। রুচিশিলা । মার্জিত নরম স্বভাব । কারো মুখের ওপর কথা বলতে পারে না । রিয়া তাই প্রথমে আপত্তি করেনি । তবে অম্লান বাবুর এই কথায় সে যেন বিদ্যুস্পৃষ্ট হয়ে পরে --


'আমার এতো ব্যবসা, এতো সম্পত্তি, বাড়ি গাড়ি সবই আমার ছেলে পাবে । একমাত্র ছেলে । বাড়ির বৌ আর অত লেখাপড়া, চাকরি বাকরি করে কি করবে ? ডাক্তারীতে অনেক ঝক্কি ! দিন নেই রাত নেই । রোগীর সবা করো । এটা একটা লাইফ হলো ? আমার বাড়িতে আরামে থাকবে, পায়ের ওপর পা তুলে..হা হা "।


বাল্যবন্ধু বলে রিয়ার বাবাও কিছু বলতে পারেননি । অম্লান বাবুর ছেলেটি ফরওয়ার্ড গোছের । প্রথম দেখার পর ফোন নম্বর চায়, তারপর কফি, সিনেমা ইত্যাদির প্রস্তাব । রিয়া নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে নরম ভাবেই । কিন্তু ক্রমে রিয়ার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো । স্বপ্নময়ের আবির্ভাব তার মনের জানলা আবার খুলে দিয়েছে ।


আর একদিন । স্বপ্নময়কে খুব অস্থির দেখে রিয়া তার কাছে গেলো । তখন স্বপময়ের বেশ জ্বর । অপ্রকৃতস্থ অবস্থা । তাকে দেখেই স্বপ্নময় বলে উঠলো


"দেখুন না ডক্টর এরা আমায় আমার মোবাইলটা দিচ্ছে না । মায়ের খবর পাচ্ছি না । মা নিশ্চই আমার চিন্তায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করেছে।.."


বলেই কেশে উঠলো স্বপ্নময় । রিয়া তাকে বললো


"আপনি এতো উত্তেজিত হবেন না দয়া করে । আপনার মা ভালো আছেন । আমরা নিয়মিত খবর দিচ্ছি ওনাকে ।"


"আপনারা বুঝতে পারছেন না । কত লোকের বাড়ি ভেঙে গেছেন জানেন ? কত লোকের কাজ নেই, তারে খাবে কি? সরকারের ত্রাণ পৌঁছাতে পৌঁছাতে সবাই না খেয়ে মরে যাবে । ওরা টাকা জোগাড় করতে পারলো কিনা কে জানে ? এতগুলো অসহায় মানুষ । আর আমি কিনা বেডে শুয়ে আছি !"


বলে আবার কেশে উঠলো । একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে স্বপ্নময়ের । রিয়া স্বপ্নময়ের পাশে বসলো । স্বপ্নময়ের চোখের চাহনিতে কি একটা ঔজ্জল্য রয়েছে, এই রুগ্ন চেহারাতেও তা স্পষ্ট । যেন অগ্নিশুদ্ধ সোনার মতো । কর্মযোগীর তেজোদীপ্তি যেন । রিয়া বললো


"দেখুন, আপনি যদি সুস্থ না হন তাহলে ওদের জন্যে কিছু করতে পারবেন কি ?"


স্বপ্নময় মাথা নিচু করলো । রিয়া বলে চললো


"আপনি খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন । অনেকে আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছে ।"

রিয়া জানে অনেকের মধ্যে সেও একজন ।


স্বপ্নময়ের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠলো । কি প্রশান্ত, কি পবিত্র সে হাসি যা রিয়ার মনে হাজার পারিজাতের সুবাস ছড়িয়ে দেয় ।


সেদিন রিয়া গিয়ে দেখে স্বপ্নময়ের বেড খালি । গতকালই বেশ অসুস্থ ছিল সে । বুকের ভেতরটা ছাঁত করে উঠলো রিয়ার । রাতের শিফ্টের কাউকে পেলো না । হঠাৎ শুনলো ওয়ার্ড বয় বলছে "বেড নং ৫ এমার্জেন্সিতে। ..অক্সিজেন লাগবে .."। স্বপ্নময়ের বেড নং ৫! তাকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেলো হঠাৎ স্বপ্নময়ের অবস্থার অবনতি ঘটেছে । হঠাৎ প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয় রাত ৩টে নাগাদ, অনেক জ্বর । তাকে এমার্জেন্সিতে ভেন্টিলেটর-এ রাখা হয়েছে । সম্প্রতি অনেক করোনা জনিত মৃত্যু দেখেছে রিয়া । বৃদ্ধ, তরুণ অনেকর মৃত্যু । কিন্তু স্বপ্নময়ের এ পরিস্থিতি যেন বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে দিলো রিয়ার । সে ছুটে গেলো এমার্জেন্সিতে । দেখলো স্বপ্নময়ের নাকে-মুখে ভেন্টিলেটর, আরও লাইফ সাপোর্ট । পালস স্টেবল নয়, মাঝে মাঝে সিংক করছে । আর সিনিয়র ডাক্তার এই মুহূর্তে কেউ নেই । রিয়া চোখ বন্ধ করে স্নায়ু শক্ত করে নিলো । সামনে কঠিন যুদ্ধ । এ যুদ্ধ যেন সে নিজের জন্যেই লড়ছে ।


এই ভাবে ৫০ ঘন্টা কাটলো । রিয়া এমার্জেন্সি থেকে নড়েনি । অভিজ্ঞ ডাক্তার পরের দিকে এসেছিলেন । কিন্তু রিয়া তার আহৃত সমস্ত ডাক্তারি বিদ্যা উজাড় করে দিয়েছে । রিয়া খুবই মেধাবী ছাত্রী ছিল । সেই কারণেই সে তার ডাক্তার শিক্ষক শিক্ষিকাদের এতো প্রিয় । আজ তার শিক্ষা সার্থক । স্বপ্নময় চোখ খুলেছে । জ্বর নেই । মুখে সেই স্বপ্নময় হাসি ।


আজ স্বপ্নময় অনেকটাই সুস্থ । ১৫ দিন হয়ে গেলো । এবার তাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে । রিয়া আজ আবার স্বপ্নময়কে দেখতে গেছে । স্বপ্নময়ের মুখে সেই হাসি ফুটে আছে । সে রিয়াকে বলে


"ড: বসু কি বলে যে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো! "


পিপিই -তে মানুষ চেনা যায়না । রিয়ার বুকের কাছে তার আই ডি কার্ড ছিল । তাই দেখেই স্বপ্নময় তাকে চিনেছে ।


"..আমি শুনলাম আপনি আমায় যমের  হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন। ..আপনার কাছে আমি চিরঋণী হয়ে গেলাম .."


রিয়ার মনে আজ হাজার পারিজাত ফুটে উঠেছে স্বপ্নময়কে সুস্থ পেয়ে, তার স্বপ্নময় হাসিতে । তার মনের ভাব হয়তো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তার ডাগর চোখে, সুশ্রী মুখে ফুটে উঠতো । কিন্তু পিপিই ভেদ করে তা অবলোকন করা স্বপ্নময়ের সাধ্য নয় । মনের ভাব গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে রিয়া বলে


"এ কি বলছেন ছি ছি । এতো আমাদের ডিউটি ।"


"ডিউটি আজকাল এতো নিপুণ ভাবে কজন পালন করে বলুন! তার জন্যে একটা একাগ্র মন থাকা চাই, নিষ্ঠা থাকা চাই । "


বলে স্বপ্নময়ের হাসি দ্বিগুণ হয়ে ওঠে ।


রিয়া ভাবে, ও কি তার মনের কথা বুঝে গেলো ? তারপরই মনে হলো কাল যদি ওকে ছেড়ে দেয় , যোগাযোগ হবে কি ভাবে ? যদি না হয় ? তাহলে কি করবে রিয়া ? কন্টাক্ট নাম্বার চাইবে ? কিন্তু সেটা কি করে চাইবে সে ? না না ! তা কিছুতেই পারবে না রিয়া ! রিয়ার নীরবতা ভেঙে স্বপ্নময় বলে

"সুন্দরবনে অনেক লোক খাবার জল, চাল, ডাল পেয়েছে জানেন । আমি কিছু টাকা ট্রান্সফার করলাম । আপনারা আমায় আমার ফোন ব্যবহার করতে দিয়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ । আরো অনেকে এগিয়ে এসেছে । এতদিনে সরকারের ত্রাণও এসেছে ।"


রিয়া কিছু না ভেবেই যেন বলে ফেললো


"আমার পরিচিত যদি কেউ ডোনেট করতে চান. . মানে করোনা বা এই ধরণের কাজে ..তাহলে?...আমি কি আপনাকে বলতে পারি ?"


স্বপ্নময় যেন আনন্দে লাফিয়ে উঠলো ! বললো


"বাঃ সে তো বেশ ভালো কথা ! আপনি আমার সাথে যোগাযোগ করুন । আপনার হোয়াটস্যাপ নম্বর বলুন ।"


রিয়া বলে । সঙ্গে তার মনের জানলা থেকে পারিজাতের সুবাস এসে তার মনটা ভরিয়ে দিলো ।


কিছুদিন কাটে । রিয়ার ধকল আরও বাড়ে । স্বপ্নময়ের সাথে আর যোগাযোগের সুযোগ হয়না । একদিন রাতে ঘরে ফিরে দেখে স্বপ্নময় হোয়াটসআপ করেছে


"সরি আপনার নম্বর তা সেদিন সেভ করলাম, কিন্তু আপনার সাথে যোগাযোগ করিনি । আজ মা সেদিনের ঘটনার কথা জেনে আপনাকে অনেক আশীর্বাদ জানাতে বললো । তাই জানালাম :-) ভালো আছেন তো ?"


রিয়ার সব ক্লান্তি নিমেষে মুছে গেলো, লিখলো


"আপনি ভালো আছেন তো ? এখন আর বেরোবেন না যেন। "


":-) সে দেখা যাবে"


"দেখা যাবে মানে? আবার অসুস্থ হলে ?"


"আপনি রয়েছেন তো । সামলে নেবেন :-)"


রিয়া চুপ করে গেলো । তার মুখে এক প্রশান্ত হাসি । এবারেও স্বপ্নময় তা দেখতে পেলো না । রিয়ার মন জুড়ে স্বপ্নময় স্বর্গের আবেশ, কোটি কোটি পারিজাত তাতে প্রস্ফুটিত । রিয়া ক্রমশঃ অবচেতনের গহীনে তলিয়ে যেতে লাগলো । হাত পা অবশ হয়ে এলো । ললিতা রান্না ঘরে ছিল । কি একটা শব্দ পেয়ে দৌড়ে এসে রিয়ার অচেতন দেহ দেখতে পেলো


রিয়া এবার চোখ খুলেছে । সে হাসপাতালের বেডে । নার্স পাশেই ছিল, বললো


"আপনি অনেকদিন অজ্ঞান ছিলেন । ব্রিদিং ট্রাবল । করোনা টেস্ট হলো । নেগেটিভ ।"


রিয়ার কিছু মনে নেই । শরীর খুব দুর্বল ।


ডাক্তার এলেন । ডঃ মুখার্জী । সিনিয়র সার্জন । রিয়ার প্রিয় মাস্টারমশাই । এনার অনুরোধেই রিয়া কোভিড ওয়ার্ড-এ আসে । ডঃ মুখার্জী রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন


"ওভার ওয়ার্ক হয়ে গেছে মা । বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও । অনেক ধকল গেছে । "


রিয়ার বাবা এসে নিয়ে গেলেন রিয়া কে । রাস্তায় যেতে যেতে বললেন


"উফ ! কেন মা জেদ করে গেলি বল ! তোর কিছু হয়ে গেলে ?"


রিয়া চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো । বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন


"ও হ্যাঁ । স্বপ্নময়ের মায়ের সাথে কথা হলো । "


নামটা শুনেই রিয়ার মনে সেই পরিচিত সুবাস আবার অনুভূত হলো । সে বিষ্ফারিত চোখে বাবার দিকে চাইলো । বাবা মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললেন


"এ এক অদ্ভুত যোগাযোগ জানিস । স্বপ্নময় রুকুর স্কুল ফ্রেন্ড । ফেসবুক এ কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পরে তুই রুকুর বোন । তুই দাদাকে বলেছিলিস অম্লানের ছেলেকে তুই বিয়ে করতে চাসনা ?"


রিয়ার মাথা নিচু হয়ে গেলো ।


"আমিও ঠিক চাইছিলাম না জানিস । কিন্তু ওই তো জানিস আমার স্বভাব, মুখের ওপর না বলতে পারি না"


রিয়ার মুখে প্রশান্ত হাসি ফুটে উঠেছে ।


"ছেলেবেলার বন্ধু তো ..যাগগে ! রুকুর মাধ্যমে স্বপ্নময় ও ওর মা তোর ব্যাপারে আরও জেনেছে । উনিও স্বপ্নময়ের জন্যে পাত্রী দেখছিলেন ..আমিও জানলাম ওর ব্যাপারে।...হীরের টুকরো ছেলে ! আই.আই.টি খড়গপুরে ফ্যাকাল্টি পসিশন পেয়েছে জানিস! ও জয়েন করতেই ফিরেছিল আমেরিকা থেকে । "


রিয়ার মনে অমরাবতীর ঢেউ উথাল পাথাল করছে । সে বাবার হাত ধরে বাবার কাঁধে মাথা রেখেছে । খুব আনন্দ হলে সে তাই করে ।


বাড়ি ফিরে রিয়া হোয়াটসাপে টোন শুনে খুলে দেখে স্বপ্নময়


"কি ডোনেশন এর কি হলো ? :-)"


রিয়া উত্তরে স্মাইলি দিলো


"এই জন্যেই তো আমার নম্বর চেয়েছিলেন? নাকি?"


রিয়া চুপ করে রইলো । লজ্জায় অনুরাগে সে আবিষ্ট । অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে লিখলো


"শুনলাম আপনি আই.আই.টি তে ফ্যাকাল্টি পসিশন পেয়েছেন । কৈ একবারের জন্যেও তো বলেননি আমায় !"


স্বপ্নময় লিখলো


":-) ওসব ছাড়ুন ...আপনাকে তো দেখতে গেছিলাম হাসপাতালে । আপনি সেন্সলেস ছিলেন । আমায় ললিতা বললো। মা কে বলি, মা তো কান্না কাটি করে একশা । যাক তারপর রুকুর থেকে জানলাম আপনি ওর বোন । এদিকে মায়ের নাকি আপনাকে ভারি পছন্দ ! হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকে আপনার ছবি দেখে, আপনার কথা শুনে । আমি বললাম -- বোঝো কান্ড! এদিকে রুকুও বলে -- তুই ছিলি কোথায় ভাই! এদিকে আমার বোনটা তো অপাত্রে দান হয়ে যাচ্ছিলো :-) :-)

কি হলো? আছেন তো?"


রিয়া তখন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন । স্বপ্নময়ের প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরলো । লিখলো

"হ্যাঁ "


"যাক ! রুকু আর আমার মা মিলে তো সেমিফাইনাল করে ফেলাইছে । কিন্তু ফাইনাল রাউন্ডটা বাকি, বুঝলেন তো ।"


রিয়া অবাক হয়ে লিখলো


"মানে?"


"মানে পাত্র পাত্রীর মত তো চাই নাকি ?? :-)"


রিয়া এতক্ষণে লজ্জায় আরক্ত হয়ে গেছে । অনেক কষ্টে একটা স্মাইলি দিলো । স্বপ্নময় বললো


"মানে শুধু আপনার মত পাওয়াই বাকি আর কি :-)"


রিয়ার দেহে মনে সেই সুবাস হিল্লোলিত । এবার সে জ্ঞান হারাবে না । কিন্তু সে কি হারিয়েছে তা সে প্রথম দিন থেকেই জানে ।