Wednesday 21 July 2021

বাঁশি

বিয়োগান্তের সুর হয়ে বাঁশি বেঁচে থাকে তৃষিতার বুকে । বিরহে যে কি সুখ আছে, অপ্রাপ্তিতে যে কি প্রাপ্তি আছে তা যুগ যুগান্তরে রাধারাণীরাই জানেন । বেণীমাধবের বাঁশি যেমন তৃপ্তির আকর হয়ে বেঁচে আছে সৃজনীর মনের মন্দিরে । টলিক্লাবে আজ পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াজির বাঁশির অনুষ্ঠান । অডিটোরিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই । যাঁরা বসার জায়গা পাননি, সিঁড়িতে বসে বা শেষ সারির পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন । সৃজনীও এসেছে তার বান্ধবীদের সাথে । সৃজনী এক বুটিক সংস্থার কর্ণধার । সৃজনীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর হলো । দুই ছেলে । বড়ো ক্লাস ৬, ছোট ক্লাস ৪ । স্বামী এক নামি আই টি কোম্পানির উচ্চ পদস্থ কর্মী । সৃজনীর মাস্টার্স পাস করেই বিয়ে । সৃজনীর আর্ট নিয়ে পড়াশোনা । এক সময় গানও গাইতো বেশ ভালো । বিয়ের পর সংসারের চাপ । যা হয় আর কি ! কিন্তু সৃজনী গতানুগতিক গৃহবধূ হয়ে থাকতে চায়নি । চিরকালই খুব কর্মঠ সে । সে গতিশীলা, প্রগতিশীলা । স্কুলে, কলেজে ফেস্ট, রক্তদান শিবির, এক্সিবিশন প্রভৃতি অনেক উদ্যোগে সে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে । দেখতে দেখতে কলেজের সহপাঠিনীদের সাথে শুরু করলো বুটিক । প্রথমে আপত্তি করলেও তার অভিনব হাতের কাজ ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে শশুর মশাই খুব উৎসাহ দিলেন । প্রথম পুঁজি তিনিই তুলে দেন বৌমার হাতে । সেই থেকে সৃজনীর পথ চলা শুরু । আজ সৃজনীর ডিসাইনার বুটিক বেশ কিছু ভালো স্টোরে পাওয়া যায় । সৃজনী ! সার্থক নামকরণ ! আজ সৃজনী নিজগুণে স্বাবলম্বী । সঙ্গে গরিব বাচ্চাদের জন্যে একটা ট্রাস্টও করেছে সৃজনী । বেশ কয়েকটা বাচ্চার পড়াশোনার ভার বহন করে সেই ট্রাস্ট । সঞ্চালকের বাঙময় ভূমিকার পর দর্শকদের করতালিতে শুরু হলো অনুষ্ঠান । রাগ ইমন, লালিত, তারপর হংসধ্বনি । মাঝে নিজের সৃষ্ট রাগ চন্দ্রায়ণও বাজালেন পন্ডিতজি । স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছাসে ফেটে পড়লো অডিটোরিয়াম । সঙ্গতে এক তরুণ বংশীবাদক ছিলেন । অনুষ্ঠানের মধ্য লগ্নে পণ্ডিতজি তাকে একটা একক বাজাতে অনুরোধ করলেন । সৃজনীর এক সময় বাঁশি খুব পছন্দ ছিল । কিন্তু এক অপ্রিয় ঘটনা তার মনের অজ্ঞাত অলিন্দে এই বাদ্যযন্ত্রটির প্রতি ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো । তাই সে কিছুতেই আসতে চাইছিলো না আজ । কিন্তু শেষে বান্ধবীদের পীড়াপীড়িতে রাজি হলো । তবে এসে বেশ ভালোই লাগছে সৃজনীর । এমন মনোহারী বাদ্য বোধ হয় কমই আছে । তরুণটি এবার একক শুরু করলো । প্রথমের কয়েকটা নোট স্পর্শ করতেই সৃজনী চমকে উঠলো । একি একি! এতো সেই সুর ! সেই সুর ! সেই মাদকতা ! এ কি করে সম্ভব ! ছেলেটির বাঁশি যেন ব্যাকুল ভাবে কেঁদে উঠছিলো । সৃজনীর মন উত্তাল হয়ে উঠলো । সে চোখ বুজে ফেললো । *** প্রায় ২৩ বছর আগেকার ঘটনা । সৃজনীর তখন বয়স ১৭ কি ১৮ । ক্লাস ১২ এ পড়ে সে । মা বাবার একমাত্র সন্তান । বীরভূমের এক গ্রাম পলশা । দূর্গা পুজোর সময় । সৃজনীর এক দূর সম্পর্কের পিসির বাড়ি পলশায় । দূর সম্পর্কের হয়েও সৃজনীর বাবার খুব আদরের দিদি । সেবার ঠিক হয়েছিল পুজোর সময় সেই গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হবে, গ্রামের পুজো দেখা হবে । সৃজনীর তাতে খুব রাগ হয়েছিল । চিরকালই কলকাতায় বড়ো হয়েছে, এখানকার পুজোর জৌলুশ, বন্ধু বান্ধব ছেড়ে কোন গন্ডগ্রামে যাওয়ার ব্যাপারটা তার একদম মনে ধরেনি । কিন্তু গ্রামে কাশ ফুলের মেলা, ধানক্ষেত, পুকুরে শালুক ফুল, নীল আকাশ, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, রাঙা মাটি দেখে তার মন নেচে উঠেছিল । পিসেমশাই লাবপুর বিডিও অফিসের বড়ো অফিসার । পিসির এক ছেলে এক মেয়ে । মেয়ে ললিতা সৃজনীর সমবয়সী । তার সাথে খুব ভাব হয়ে গেলো সৃজনীর । সেদিন সবাই মিলে সন্ধ্যাবেলায় কৃষ্ণলীলা পালা দেখতে গেলো । ষষ্ঠীর দিন প্রতিবার নাকি গ্রামে যাত্রা পালা হতো । গ্রামে ঢুকতেই একটা পাকা ঠাকুর বাড়ি ছিল, তাতেই গ্রামের সব পুজো হতো । তার পাশে একটা খোলা জায়গায় মাচা বেঁধে তিরপল টাঙিয়ে যাত্রা পালার ব্যবস্থা । মেঝেতেও কাপড় পাতা হয়েছে সবার বসার জন্যে । যদিও শীত পড়েনি, সন্ধ্যে শেষে রাত নামার বেলায় হালকা শিশির পরে । তাই এতো আয়োজন । পালা শুরু হলো । পিসির মেয়ে ললিতা বলেছিলো "কৃষ্ণটাকে যা দেখতে না, চোখ টেরিয়ে যাবে ! আর দেখবি কেমন বাঁশি বাজায় ।" সত্যি তাই । যে কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করছিলো তাকে দেখে সৃজনীর কি যেন একটা হয়েছিল সেদিন । যেন সত্যি কৃষ্ণ । শ্যামলকান্তি, কমল নয়ন, পেলব হাসি আর সে নয়নে, সে হাসিতে কি যেন একটা মায়া । আর তেমনি তার বাঁশি । অভিনয়ের সময় বাঁশি নিজেই বাজালো ছেলেটি । কি তার গভীরতা, কি তার মাদকতা । শুনে সৃজনীর মনে যে কি ঢেউ উঠেছিল তা সেই জানে । পালা শেষে গ্রামসুদ্ধ করতালিতে ফেটে পড়লো । ছেলেটি যেন এক ঝলক সৃজনীর দিকে চাইলো কারণ একমাত্র সেই হাততালি দিচ্ছিলো না । চমক ভেঙে সৃজনী ভীষণ অপ্রস্তুক হয়ে বেতালে হাততালি দিলো । রাতে ভালো ঘুম হলোনা সৃজনীর । সেই মুখ আর সেই ব্যাকুল করা সুর সব সময় তার চেতনা আবিষ্ট করে রইলো । এইভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানেনা। হঠাৎ যখন ঘুম ভাঙলো তখন ভোরের আলো ফোটেনি । সৃজনী শুনলো সেই বাঁশির সুর ! সে ধড়মড় করে উঠে বসলো খাটে । পাশে ললিতা ছিল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । কোথা থেকে আসছে এই সুর ? নাকি ভুল শুনছে সৃজনী ? সেই মায়াবী সুর যেন বলছে "হ্যাঁ গো, তোমাকেই ডাকছি, শুনতে পাচ্ছো না ?" । দুহাতে সৃজনী কান বন্ধ করে ফেললো । এ যে সহ্য হয়না ! হাত সরিয়ে দেখলো এখনো ব্যাকুল সুরে বেজে চলেছে সেই বাঁশি । তার তনু মন যেন মাদকাসক্ত হয়ে উঠতে লাগলো । আর পারলো না সৃজনী । বাড়ির পেছন দিকে একটা দরজা ছিল, পেছনের মেঠো রাস্তায় খুলতো । বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি । শিকল খুলে বেরিয়ে পড়লো সৃজনী । কোথা থেকে আসছে এই সুর ? বাড়ির পেছনে একটা ছোট মাঠ, তার ঈশান কোণে শিউলি গাছ । তারপর বাঁশবন, তার ওপার থেকে বোধ হয় । ছুটে চললো সৃজনী পাগলের মতো । যেন তার জীবনে আর কোনো উদ্দেশ্য নেই । ঘাসের ওপর শেষ রাতের শিশির, তাতে খালি পায়ের পাতা ভিজে গেলো সৃজনীর । সদ্য ঝরা শিউলি পায়ে দলে, তাদের সুবাস পায়ে মেখে ছুটে চললো সে । বাঁশ বনে মাথা উঁচু করে থাকা গাছের ছায়াঘেরা পথে ছুটে চললো সৃজনী । আকাশে তখনও ম্লান চাঁদ । পৃথিবী যেন অধীর আগ্রহে সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করছে । বন পেরিয়ে সৃজনী একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লো । আশে পাশে কাশফুল হয়ে আছে অগুণতি । আর একটু এগোলেই পুকুর দেখা যাবে । এখানেই গ্রামের মেয়েরা, বাড়ির বৌয়েরা স্নান করতে আসে, বাসন মাজতে আসে । সুখ দুঃখের কথা বলে । তার পাড়েই এক অশ্বত্থ গাছ । তার নিচ থেকেই আসছে এই সর্বনাশী সুর । দৌড়াতে দৌড়াতে এবার আধ ফোটা আলোয় দেখতে পেলো সৃজনী । তার দিকে পীঠ করে বসে আছে এক দীর্ঘাঙ্গী বলিষ্ট পুরুষ মূর্তি । তার হাতের বাঁশি এই নৈসর্গিক মায়া সৃষ্টি করে চলেছে । অশ্বত্থের বিশ হাতের মধ্যেই এক ছোট পেয়ারা গাছ । তার গা ধরে দাঁড়ালো সৃজনী । এই সুর তাকে পাগল করে দিচ্ছিলো । তার স্রষ্টা তার বিশ হাতের মধ্যেই । কার টানে এসেছে সৃজনী -- স্রষ্টার না সৃষ্টির ? এরা কি আলাদা ? ঈশ্বর আর তার সৃষ্ট জগৎ কি আলাদা ? এই জগতেই তো তাঁর বাস । কখন এক পা এক পা করে সৃজনী এগিয়ে গেছে তা সে টের পায়নি । খালি পায়ে বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে । হঠাৎ পায়ে কি একটা ফুটলো । "উঃ" শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে । বাঁশি থেমে গেলো । বাদক ঘুরে তাকালো । তখনি ভোরের প্রথম আলো ফুটলো । সেই আলোয় দেখলো সৃজনী । সেই চোখ । সেই পেলব মুখ । সেই মায়া । সৃজনী স্বপ্নহতের মতো চেয়ে রইলো । কোথা থেকে নাম না জানা পাখি ডেকে উঠলো । মোরগ ডেকে উঠলো । ২-৩ টে গরুর সমবেত স্বর । কুকুরের ডাক । এই জীবন্ত দুর্বাদল শ্যাম মূর্তি তার দশ হাতের মধ্যেই । তার দিকে চেয়ে আছে, প্রথমে অবাক হয়েছিল, কিন্তু এবার তার মুখে মধুর হাসি ফুটেছে । এবার মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো সৃজনী । এই বারে যেন তার ঘোর কাটলো । হঠাৎ ভীষণ ভয় পেলো, সঙ্গে এক রাশ লজ্জা । তার মুখ আরক্ত হয়ে গেছে, ঊষা লগ্নের আকাশের মতোই । আর কিছুতেই এগোতে পারলো না সে । দৌড়ে বাঁশ বন পেরিয়ে, ফিরে গেলো সে । খোলা পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে শেকল তুলে দিলো । কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলো । তার বুকে যেন দুরমুশ বাজছে । না, তখনও এদিকে কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি । ধীরে ধীরে সে ললিতার পাশে শুয়ে পড়লো । সে তখনও ঘুমে আচ্ছন্ন । সপ্তমী । সারাদিন হই হুল্লোড় করে কাটলো । সকালে স্নান করে ললিতার সাথে পুজোর জোগাড়ে লেগে পড়লো সৃজনী । গ্রামের পুজো । কোনো বাইরের আড়ম্বর নেই । জোগাড়যন্ত্র সব গ্রামের লোকেরাই করে । পুরোহিতও এই গ্রামের মানুষ । ঢাকিরাও । যেন একটা আত্মিক টান অনুভাব করলো সৃজনী । এমন ভাবে পুজো উপভোগ করেনি সে কোনোদিন । এ যেন তার বাড়ির পুজো । তারই পুজো । পাড়ার মহিলাদের কথা কানে এলো সৃজনীর 'কে বাঁশি বাজাচ্ছিল বলতো আজ ভোরে?' 'কে আবার? ওই বাগদি পাড়ার ছেলেটা গো, যে কেষ্ট সেজেছিল, নকা না লকা, কি জানি নাম । পুজোর সময় গেরামে এসেছে । কীর্তনের দল, যাত্রার দলের সাথে তো এগেরাম সেগেরাম ঘুরে বেড়ায় । বাড়ি এলে ভোর বেলায় বাঁশি বজায় । ঢং যত সব ।' 'কি মিঠে সুর গো। আর কেমন শ্যাম শ্যাম চেহারা ' 'শ্যাম না ছাই ! লক্ষীছাড়া, বাউন্ডুলে !!' সৃজনীর অভিসারের কথা কেউ জানল না । কিন্তু সেই বংশীবাদককে সারাদিন কোথাও দেখতে পেলো না সে । তবে জানলো ছেলেটির ভালো নাম বেণীমাধব । বাগদি পাড়ায় বাড়ি । সূর্যালোকে সেদিকে যাওয়া শোভন হবে না । পরের দিন খুব সকালে সন্ধি পুজো । সবাই আমোদ আহ্লাদ করতে করতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো । মনে উচাটন নিয়ে শুয়ে পড়লো সৃজনীও । আবার ঘুম ভাঙলো সেই বাঁশির ডাকে! কাক ভোর । সৃজনী এবার আর নিজেকে আটকাবার চেষ্টা করলো না । কারণ সে জানে সেই দুর্নিবার টান উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই । পেছনের দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে পড়লো । এবার সে জানে কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তাকে । মাঠ, শিউলিতলা, বাঁশবন, কাশ বন, পেয়ারা গাছ, অশ্বত্থ গাছ । বাঁশি বেজে চলেছে । কখন সৃজনী তার ঠিক পেছনে গিয়ে বসেছে সে জানেনা । সৃজনী আর নিজের বশে নেই । তার হৃদপিন্ড দুর্দম বেগে ধাবমান । আগুনের স্ফুলিঙ্গ সঞ্চার করা হাপরের মতো জোরে জোরে তার নিঃশ্বাস পড়ছে । বাঁশি থামলো । ছেলেটি এইবার বুঝতে পেরেছে সৃজনীর উপস্থিতি । সে ফিরে দেখতে না দেখতেই সৃজনী তাকে জড়িয়ে ধরলো সবেগে । সৃজনী আর কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছে না নিজেকে । হঠাৎ অস্ফুট চিৎকার আর 'ঝম' শব্দে যুগলের আচ্ছন্নতা কাটলো । দুজনে সেদিকে দেখলো । মুখে হাত দিয়ে এক মহিলা । চোখে মুখে আতঙ্কিত বিস্ময় । পুকুরে বাসন মাজতে এসেছিলেন । হাত থেকে বাসন পড়ে গেছে । হল ভাঙা হাততালিতে বর্তমানে ফিরে এলো সৃজনী । তরুণ ছেলেটি কি বাজানোটাই না বাজালো । সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো । যেমন সুর তেমন মিষ্টতা । তেমন আকুতি । ছেলেটির গায়ের রং ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ, মাঝারি গড়ন, উজ্জ্বল মুখশ্রী । প্রথম সারিতে, ছেলেটির সামনেই বসে ছিল সৃজনী । এতক্ষণে ছেলেটিকে চিনতে পেরেছে সে । *** বীরভূমের ঘটনার পর অনেক বছর কেটে গেছে তখন । সৃজনী তখন কলেজে পড়ে, ফাইনাল ইয়ার । শীতের ছুটিতে বন্ধুরা মিলে মুর্শিদাবাদ বেড়াতে গেছে । হাজার দুয়ারী দেখে একটা গেস্ট হাউসে উঠেছে । ভেতরে মোবাইলের টাওয়ার পাচ্ছে না বলে বাইরে এসে কথা বলবে এমন সময় শুনলো বাঁশি ! সেই সুর ! এক নিমেষে ব্যাকুল করে দিলো সৃজনীকে । পাগলের মতো সুর লক্ষ্য করে ছুটে চললো সৃজনী । কিছুটা যেতেই দেখলো একটা মাইল ফলকের ওপর বসে ১০-১২ বছরের একটা ছেলে বাজাচ্ছে । অবিকল সেই সুর, কিন্তু অপটু ! সৃজনী কাছে যেতেই ছেলেটি বাঁশি থামিয়ে সৃজনীর দিকে চাইলো । বেশ উজ্জ্বল চেহারা ছেলেটির । ঈষৎ কৃষ্ণবর্ণ । সৃজনী ব্যগ্র হয়ে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো "কে শেখালো তোমায় এই সুর ?" ছেলেটি খানিক অপ্রস্তুক হয়ে তাকালো, তারপর বললো "আমার গুরুজী " সৃজনীর ভেতর তোলপাড় করতে শুরু করেছে, বললো "তাঁর কাছে নিয়ে যেতে পারো আমায়? এক্ষুনি! " ছেলেটি অবাক হলো । তারপর রাজি হলো । পড়ন্ত বিকেল । শীত পড়েছে । শীতে এদিকে পাড়া নিঝুম হতে থাকে সন্ধে নামলেই । সেদিকে সৃজনীর একটুও খেয়াল নেই । সে উদ্ভ্রান্তের মতো চলেছে ছেলেটির পিছু পিছু । ঠিক যেন দিশেহারা নাবিক রাতের অন্ধকারে দ্বীপের সন্ধান করে সুদূরের বাতিঘরের আলোকে । কয়েকটা বাঁক নিয়ে, গলি পেরিয়ে অনেকটা হাঁটার পর একটা পাকা বাড়িতে নিয়ে গেলো ছেলেটি । ছেলেটি "গুরুজী" বলে বার কয়েক ডাকতেই এক মাঝ বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন । ফর্সা । ছোট খাটো চেহারা । সৃজনী হয়তো অন্য কাউকে দেখবে আশা করেছিল । দপ করে যেন নিভে গেলো সে । বিমূঢ়তা কাটিয়ে সুরের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই বললেন ভদ্রলোক "দিদিমনি এ তো প্রচলিত সুর। কৃষ্ণ বন্দনার সুর । বীরভূম,মুর্শিদাবাদ, মালদায় কীর্তনিয়ারা বাজিয়ে থাকেন । কিন্তু কেন বলুন তো ?" সৃজনী গহীন নৈরাশ্য আড়াল করে বললো "না আসলে খুব ভালো লাগলো, তাই জানতে ইচ্ছে হলো । ছোটবেলায় আমার পরিচিত একজন বাজাতেন তাই ভাবলাম .." চুপ করে গেলো সৃজনী । তারপর ভদ্রলোককে নমস্কার করে ছেলেটিকে বললো "আমায় গেস্ট হাউস পৌঁছে দেবে ভাই ? আমি তো এখানে পথ ঘাট ভালো চিনিনা । ঠিক ঠাক ফিরে যেতে পারবো কিনা বুঝতে পারছিনা ।" ছেলেটি ভারী মিশুকে । নাম দুর্লভ । সৃজনী একটা দোকান থেকে ক্যাডবেরি কিনে দিলো তাকে । সঙ্গে পার্সটা এনেছিল । ভারী খুশি হয়ে দুর্লভ সৃজনীর সাথে গল্প করতে করতে পথ চলতে লাগলো । গেস্ট হাউসের কাছাকাছি এসে দুর্লভ বললো "আজ একটু পরেই এখানে একটা কীর্তনের পালা বসবে, যাবে নাকি দিদিমণি ? শহরে এমনটি পাবে না কিন্তু !" প্রথমে গররাজি হয়ে কি যেন ভেবে শেষে সৃজনী রাজি হলো । দুর্লভ হেসে বললো "আমি এসে নিয়ে যাবো, তৈরী হয়ে থেকো কিন্তু ! " সত্যি অসাধারণ পালা । সৃজনীর সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুও এসেছিলো । সবার মন ভরে গেলো । কৃষ্ণ ঠাকুরের রাশ লীলাকে সাজিয়ে নতুন রূপ দেয়া হয়েছিল । যেমন গায়কী, তেমন অভিব্যক্তি। সঙ্গে অসাধারণ জোড়া খোলের সঙ্গত । শেষে রাধা কৃষ্ণের মিলন দৃশ্যে হঠাৎ নেপথ্যে বেজে উঠলো বাঁশি ! সেই সুর । সেই পাগল করা সুর । সেই মায়া । সেই ব্যাকুলতা । এক লহমায় সৃজনীর সেই পুরোনো স্মৃতি প্রাঞ্জল হয়ে উঠলো । পলশা । সেই অশ্বত্থ গাছ । সেই বংশীধারী । সৃজনী এই সুরের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলো । পারলো না । পেছন দিকটায় একটু আলোআঁধারী ছিল । মনে হলো পেছনে বসে কেউ যেন বাঁশি বাজাচ্ছে । তার মুখ দেখতে পেলো না । পালা শেষে লোকজন বাহবা করতে করে চলে গেলো । অনেকে বংশীবাদকের সাথে দেখা করতে চাইলো । দলপতি বললেন "উনি দেখা করেন না" সৃজনী অনেক কাকতি মিনতি করলো তাঁর সাথে দেখা করবে বলে । শেষে দুর্লভের পরিচিত বলে সে সুযোগ পেলো । একটা কুঁড়ে ঘরের চাতালে একা বসে ছিলেন তিনি । সৃজনী ধীরে ধীরে তাঁর কাছে গেলো । তাঁর মাথা নিচু, চুলের ধারা নেমে এসেছে মুখ বেয়ে । সৃজনী ডাকলে তিনি মুখ তুললেন । সেই মুখ ! কিন্তু একি ! সৃজনী আঁতকে উঠলো । তাঁর একটা চোখ কাপড় দিয়ে বাঁধা, মুখের সেদিকে কুৎসিত পোড়ার দাগ । সেই সপ্রতিভ ভাব আর নেই । সেই রূপ আর নেই । শরীর অনেকটা পড়ে গেছে । সৃজনী মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো "কে করলো তোমার এ অবস্থা ? কে ?" কান্না শুনে দলের লোকজন ছুটে এলো "দিদি ওঁকে দয়া করে আর বিরক্ত করবেন না । ওনার বিশ্রামের সময় হয়েছে । ওনার শরীর ভালো নেই ।' সৃজনী বেরিয়ে পাশের এক আম বনের দিকে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো । কেউ তার কান্না শুনলো কিনা সে জানে না । সে জানে, তার জন্যেই বেণীমাধবের আজ এই অবস্থা ! বন্ধুরা সৃজনীর এমন রূপ কখনও দেখেনি । তাকে ধরাধরি করে গেস্ট হাউসে নিয়ে এলো তারা । কিন্তু সৃজনীর করুন চেহারা দেখে বিশেষ কিছু জানতে চাইলো না । সৃজনী রাতে প্রায় কিছু খেলো না । এক বান্ধবীর সাথে রুম শেয়ার করে ছিলো গেস্ট হাউসে । সৃজনী কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়লো ।কিন্তু সারারাত ঘুম হলোনা তার । তার অন্তর ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো । সেদিন গ্রামে যেন কত হাজার চোখের বিদ্রুপ ছিছিকারে ভয়ে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলো সে । তাও সে চিৎকার করে বলেছিলো -- "বেণীমাধবের কোনো দোষ নেই, কোনো দোষ নেই ওর ! তোমরা ওর কোনো ক্ষতি করোনা !" পরে শুনেছিলো এই নিয়ে গ্রামে তুমুল গোলমাল হয়েছিল । সৃজনীর বাড়ির লোককে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল । কিন্তু পিশেমশাইরা গ্রামের গণ্যমাণ্য ব্যক্তি, উচ্চ বর্ণের সম্ভ্রান্ত পরিবার । তাই শেষে কেউ তেমন দোষ নেয়নি । তবে গরিব, নিচু জাত হওয়া পাপ । তাদের অপরাধ অমার্জনীয় । ভোর আসন্ন । সৃজনীর সাথে যে বান্ধবী শুয়েছিল, সে তখন গভীর নিদ্রামগ্ন । সন্তর্পনে সৃজনী দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো । গেস্ট হাউসে তেমন কড়াকড়ি নেই । মেন গেট খোলাই ছিল । সৃজনী হন হন করে বেরিয়ে গেলো । একটু দূরেই সেই মাইল ফলক যেখানে কাল দুর্লভ বসেছিল । সেখান থেকেই তার গুরুজীর বাড়ি গেছিলো কাল । অন্ধকারে পথ ভালো করে দেখেনি সে । তাও চেষ্টা তো করতেই হবে । কিন্তু কিছুটা গিয়ে আর রাস্তা চিনতে পারলো না সৃজনী । অসহায়ের মতো এদিক ওদিক চাইতে লাগলো সে । কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না সে । এই পাপের ভার নিয়ে কি করে বেঁচে থাকবে সে ! এমন সময় দেখলো দুর্লভ ছুটতে ছুটছে আসছে তারই দিকে । কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো "তোমার কাছেই আসছিলাম গো ।" সৃজনীকে একটা কাগজ দিলো "চিঠি। তোমার জন্যে ।" সৃজনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো "কার চিঠি ?" "মাধব গোঁসাই দিতে বলেন তোমায় । আসলে উনি আমার গুরুজির গুরুভাই । এখানে এলে উনি আমার গুরুজীর বাড়িতেই থাকেন । আমি পাশেই থাকি । আমায় ঘুম থেকে তুলে বললেন তোমায় দিয়ে আসতে ।" সৃজনী অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ছেলেটির মুখের দিকে চেয়ে থাকে । তারপর চিঠি হাতে নিয়ে খুলে দেখে লেখা "সেদিন আমাদের একসাথে দেখে গেরামের লোক ক্ষেপে গেছিলো । আমি নিচু জাত, তুমি বামুনের মেয়ে । আমায় লোকে কত মারধোর করলে । হাতে যা পেলো তাই দিয়ে মারলে । একজন জ্বলন্ত ধুনুচি ছুঁড়ে মারলে আমার মুখে । একটা চোখ তাতেই. .। মুখ তো আগেই পুড়েছিল ! কোনো রকমে প্রাণে বাঁচলাম । আর গেরামে ঢোকা হলো নাকো । কিন্তু হয়তো এই ভালো হলো । আমার রূপ রইলো নাকো । কাউকে মজাবার ক্ষেমতাও রইলো নাকো । মনে হয়তো পাপ ছিল, গোবিন্দ হয়তো তারই শাস্তি দিলেন । কিন্তু আমার বাঁশিখানা রইলো, আমার সুর রইলো । মনের মতো গুরু পেলাম । কৃষ্ণ সাধনায় ডুবে গেলাম । এতে যে কি সুখ, কি শান্তি, কি তৃপ্তি কি বলবো তোমায় । তাই তুমি দুঃখ করোনাকো । আমি ভালোই আছি । তুমি ভালো থেকো । মিছে কষ্ট পেওনাকো । আর আমায় ভুলে যেও । " শেষ কথাগুলো যেন শেলের মতো বিঁধলো সৃজনীর বুকে । আজ মনে মনে অনেক সংকল্প করে বেরিয়েছিল, চিঠি পড়ে তার মনোরথ থমকে গেলো । নাঃ ! বেণীমাধব তার জন্যে অনেক কষ্ট পেয়েছে । তার শান্তির পথে আর কাঁটা হবে না সৃজনী । ভোরের প্রথম আলো ফুটলো, সৃজনী যেন চোখে মুখে তার মৃদু উষ্ণতা পেলো । সৃজনীর চোখে জল । কিন্তু তাতে শুধু ব্যাথা, শুধু অপরাধ-বোধ নয় । এক প্রশান্ত উপলব্ধিতে যেন পবিত্র হয়ে উঠলো সে । সৃজনী পার্স হাতড়ে কিছু টাকা দুর্লভের হাতে দিলো, বললো "পুজোয়, একটা ভালো. ..ভালো বাঁশি কিনো, কেমন ? " *** রম রম করে অনুষ্ঠান শেষ হলো । শেষের দিকে চেনা গানের কিছু সুর বাজালেন পণ্ডিতজি ও সহশিল্পীবৃন্দ । তাঁর উৎসাহে পুরো অডিটোরিয়াম সেই গান বাঁশির সুরে সুরে গেয়ে উঠলো । অনুষ্ঠান শেষে সৃজনী অনেক অনুরোধ করে বংশীবাদক ছেলেটির সাথে দেখা করার সুযোগ পেলো । দুর্লভ চিনতে পারলো সৃজনীকে "দিদিমণি, তুমি ! কতদিন পর। " সৃজনী তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো "কত বড়ো হয়ে গেছো ! আর কি ভালো বাজাতে শিখেছো !" দুর্লভ মৃদু হেসে মাথা নিচু করলো, বললো "মাধব গোঁসাই তো আর নেই গো। ....তোমার সাথে সেই দেখা হওয়ার পরদিনই, একা একা বেড়াতে বেরিয়েছিলেন । আমি সঙ্গে যেতাম, সেদিন যেতে দেরি হয়েছিল । তিনি কাউকে কিছু না বলে একাই বেরিয়েছিলেন, সন্ধ্যে হয়ে এসেছিলো । পাকা রাস্তা পেরোতে গিয়ে, ট্রাকের ধাক্কায় ...।" শুনে সৃজনী চুপ করে গেলো । দিনে দিনে যে তুষাগ্নি ধিকি ধিকি তার মনে জ্বলছে, তা যেন তার সারা অঙ্গ জ্বালিয়ে দেবে এইবার । এই জ্বালা ভুলতেই তো সব সময় কাজে ব্যস্ত রাখে নিজেকে । পিছিয়ে থাকা মানুষদের পাশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে । এই ভাবেই সে প্রায়শ্চিত্ত করে এসেছে এ কবছর । দুর্লভ বলে চললো "শেষ সময় তোমার কথা বলছিলেন জানো । আর যাওয়ার সময় আমায় তাঁর বাঁশিখানি দিয়ে গেছেন । আর এই সুর উনিই আমার গুরুজীকে শিখিয়েছিলেন ।" বলে দুর্লভ তার ব্যাগ থেকে একটা পুরোনো বাঁশি বের করলো, বললো "আমার সাথে রাখি সব সময় । মনে হয় যেন উনি আমার সাথে আছেন ।" সেই বাঁশি বুকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললো সৃজনী । দু চোখ বেয়ে অবিরাম ধারা । তার সঙ্গিনীরা অনেক খুঁজে এসে দেখে অবাক । তারা কেউ কিছু বুঝলো না । বিয়োগান্তের সুখ হয়ে সেই বাঁশি সৃজনীর অন্তর আলো করে দিলো । -- কৃপা

No comments:

Post a Comment