Friday 23 October 2020

স্বপ্ন

 (১)


আমার জন্মের সময়েই মা চলে গেলো বলে আমার নাম 'অপয়া' । যত বড়ো  হয়েছি আরও কত নাম যে কুড়িয়েছি -- বেয়াড়া, বেয়াদব, অকাল কুষ্মান্ড, কুলাঙ্গার -- তার হিসেব নেই । তাই আর আসল নাম নিয়ে মাথা ঘামাই না ।

ছেলেবেলা থেকেই আমি একটু অন্য রকম । আর পাঁচটা 'ভালো ছেলে'-এর মতো নই । একটা ঘর ছিল আমার -- তাতে নিজের খেয়ালের জাল বুনতাম, এলোমেলো, অগোছালো ছন্দে । সেই ঘরের নাম দিয়েছিলাম 'মন' (জানি সেটাকে ওরা বলতো 'উচ্ছন্ন')।  ভালোবেসে বাবা আমায় একটা গিটার দিয়েছিলো । তাতেই গুন্ গুন্ করে সুর ভাঁজতাম  । ওই একটা বিষয়েই মন ছিল আমার । পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না । কিন্তু তাতে তেমন আগ্রহ ছিল না ।
শুনেছি মা নাকি খুব ভালো গান গাইতো । গানের মাস্টার বলেছিলো নাকি আমার হবে । কিন্তু হওয়ার আগেই আমার নতুন মা তাকে বিদেয় করলো । 

বারান্দায় অনেক পাখি আসতো -- মৌটুসী, দোয়েল, বুলবুলি, বেনেবৌ, ময়না, ফিঙ্গে  -- আরও কত কি । আমাদের বাড়িতেই একটা বাগান ছিল কিনা, তাই আসতো তারা । শুধু তারাই বুঝতো আমায়, আমি তাদের । তাদের কিচিমিচিতে গানের কথা  খুঁজে পেতাম । আকাশের দিকে চেয়ে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা । সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নামতে দেখতাম, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত । আর দেখতাম মুহুর্মুহু বদলে যাওয়া পৃথিবীটাকে । রামধনুর সাত রঙে সাত সুর খুঁজে পেতাম । রাতে ঘুম ভেঙে গেলে তারাদের মিটিমিটি মর্স কোড ডিক্রিপ্ট করতাম, ব্রম্ভান্ডের কত রহস্য জেনে ফেলতাম চুপিচুপি । জোনাকীর নিয়ন-নৃত্যে  বিভোর হতাম  । ভোরে শিশির ভেজা ফুলে ভ্রমরের সিম্ফনি শুনতাম চোখ বন্ধ করে।


(২)

সেবার গ্রামে দেশের বাড়ির  দূর্গা পুজোয় গেছিলাম । তখন কলেজে পড়ি  । বাতাসে ঢাকের বোল মনে তরঙ্গের  সঞ্চার করছিলো । তবে আমি তেমন মিশুকে নই । তেমন একটা বেরোতাম না । আর কেউ তেমন একটা ডাকতোও না আমায় । ঘর, বারান্দা থেকেই পুজোর আমেজটাকে আত্মস্থ করতাম । 

একদিন চিলেকোঠায় গিটার নিয়ে নতুন গানটা  শেষ করছি । হঠাৎ নূপুরের  মতো সুরেলা কণ্ঠ শুনে ঘোর কাটিয়ে দেখি সে ! কতক্ষণ সে এসে দাঁড়িয়েছে জানিনা । এর আগে তাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লো না 
"বাহ্! এটা তো আগে শুনিনি ! তোমার বানানো বুঝি ?" 
বলে সে চুপটি করে বসে পড়লো আমার পাশে । 
"পুরোটা শোনাও না প্লিস !" 

এক লহমায় অচেনার জড়তা চুরমার করে কেউ এমন কাজ করতে পারে দেখে রীতিমতো অবাক হলাম । তারপর কিছুক্ষণ ভেবে প্রথম থেকে গানটা গেয়ে শোনালাম । চোখ বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলো সে । এমন শ্রোতা এর আগে জোটেনি আমার । তার উপস্থিতি যেন এক মায়াময় সংগীত আবহাওয়া তৈরী করতো আমার মনে । তাই সেদিন তার নাম দিয়েছিলাম 'মায়া' । পরে অবশ্য ভাবতাম সে  'আলেয়া' । তারও পরে বুঝেছিলাম, ভুল করেছিলাম । 

চিলেকোঠা থেকে ওঠা নামার অন্য একটা পথ ছিল ।  ভাঁড়ার ঘর হয়ে । সেই পথে আসতো সে,  সন্ধ্যে হলে ।  এ পথের সন্ধান সে কি করে  জেনেছিলো কে জানে ! আমায় চুপিচুপি নিয়ে চলে যেত গ্রামের প্রান্তে সেই কাশ বনটা পেরিয়ে, সেই শিউলিতলায় । কাছেই একটা পুকুর ছিল । তার পারেও যেতাম মাঝে মাঝে । সঙ্গে নিতাম আমার গিটারটা । আকাশ, চাঁদ, শিউলির সুবাস আর আমার গান । চোখ বুজে শুনতো মায়া ।  

সেই একবারই  কেমন যেন অস্থির হয়েছিল সে । আমায় জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলো । বলেছিলো 
"আর বোধ হয় দেখা হবে না ..!!" 
ভারি ছেলেমানুষ সে। ভারি ইমোশনাল, বেহিসেবী হয়ে পড়েছিল সেবার ।    

সেই সন্ধ্যেয় শেষবার দেখেছিলাম তাকে । বলেছিলো "আমায় মনে রেখো .. তোমার গানে গানে" । কাশ, শিউলি সাক্ষি ছিল সেদিন। শুনেছিল আকাশের চাঁদ তারা । পরে জেনেছিলাম তার অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেছে । মায়া যেন আলেয়া হয়ে বিলীন হয়ে গেলো আমার জীবন থেকে । নিজেকে যন্ত্রণা দিয়েছিলাম, শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম নিজেকে । হাতের নাড়ি বয়ে প্রাণ বেরিয়ে যেত আর একটু হলেই, বাবা এসে না পড়লে ! সেই ক্ষত এখনো আছে মনে, তার দাগ হাতে । তার নাম দিয়েছি 'স্মৃতি' । যতবার হাতের দিকে দেখতাম কানে বাজতো  "আমায় মনে রেখো .. তোমার গানে গানে " ।

(৩)

কতদিন কেটে গেছে । ৮ বছর ? আজ চতুর্থী । সন্ধেবেলায় একাডেমিতে আমার অনুষ্ঠান । শারদীয়া সংগীতানুষ্ঠান । ফুল হাউস । বেশ জমাটি অনুষ্ঠান হলো । 'জোনাকীর jazz', 'ভ্রমরের সিম্ফনি', 'শিশিরের সুর', 'পলাশের ঘুম' -- এগুলো দুবার করে গাইতে হলো । শ্রোতারা শেষের দিকে গলা মেলালেন । শেষে অগণিত অটোগ্রাফ-সেলফির আবদার । সঙ্গে কয়েকটা বাংলা নিউস চ্যানেলের সাংবাদিকরা । এসব আমার একদম ভালো লাগেনা ।  কিন্তু কি আর করার !

এতো কিছু সেরে  ব্যাক স্টেজে গিয়ে দেখি আলেয়া ! নাকি মায়া? সঙ্গে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে । সেই চেনা কণ্ঠস্বর (একটু ভারী হয়েছে কি ?)
'আমার ছেলে । ও তোমার খুব ভক্ত ।' 
ওর চোখে সেই মায়া তখনো জেগে আছে । 
'ওর নাম রেখেছি স্বপ্ন । ভারী সুন্দর গানের গলা জানো ।'

বলে আমার চোখের দিকে সেই শেষ দিনের মতন করে চেয়ে রইলো সে । মুহূর্তে সেই স্মৃতি  প্রাঞ্জল হয়ে উঠলো । চিলেকোঠা, কাশ, শিউলি, পুজো ...! আমি সব মনে রেখেছি, গানে গানে । যেমনটি সে চেয়েছিলো । এতো গানে -- তাদের সুরে, কথায়, অভিব্যক্তিতে -- তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত বেঁচে আছে । সেই ক্ষত আজও জেগে আছে আমার মনে -- অদম্য অনুপ্রেরণার আগুন হয়ে । মায়া যে আলেয়াও সে । সুখের মতোই সে ক্ষণস্থায়ী । তবু তার আবেশ রয়ে যায় আমরণ ।

জানলাম তার স্বামী এ শহরেই চাকরি করে । রাস্তার ধারে হোর্ডিং -এ আমার অনুষ্ঠানের খবর পেয়েছে এসেছে । ভালো বিয়ে হয়েছে তার । কিন্তু আমায় কি ভুলতে পেরেছে সে ? তার নীরব চাহনি যেন হাজার বছরের না বলা ইতিহাস ব্যক্ত করছে । 
ছেলের মাথায় হাত রেখে বললো 
'ওকে শেখাবে? ওর বয়স বয়স ৭।'

কিছুক্ষণ ওর দিকে চাইলাম  অবাক হয়ে । ঠিক যেমন অবাক হয়েছিলাম সেই প্রথম দিন । তারপর ছেলেটির দিকে চাইলাম । তার নিষ্পাপ চোখে কি জানি দেখলাম । স্বপ্ন ? তাই হবে! মুখে তার অনাবীল হাসি । আর সেই মায়া -- যা আমায় জিইয়ে রেখেছে এতদিন !

স্বপ্নকে বুকে জড়িয়ে নিলাম।  এ স্বপ্ন যেন আমারও ।

 'কাশের দেশ', 'শিউলির সাধ', 'মেঘের বিদ্যুৎ' আরও কত কিছু শেখালাম তাকে ।   দেখলাম সেও পাখির ভাষা বোঝে, ভ্রমরের সুর চেনে ।  চেনে রামধনুর রঙে সাত সুর ।  

--

কৃপা 

No comments:

Post a Comment