Monday 2 October 2017

আবার মিঠুন চক্রবর্তীর খপ্পরে !


 


২০১১ সালে কোনো এক রবিবার একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে দেখেছিলো ISI-এর প্রসেনজিৎ-দা, জিয়া-দা, দীপা-দি, কণা (দীপাদির বোন) প্রভৃতিরা আমার হাস্যময় "photogenic face" আর সেটি অঙ্কনরত জনৈক মিঠুন চক্রবর্তীকে । এখানে বলে রাখি, এই মিঠুন চক্রবর্তী একজন পোর্ট্রেট শিল্পী, আমাদের ডিস্কো ডান্সার মিঠুন-দা নন । এই শিল্পীর কাজই হলো আমার মতন "মুখের-ওপর-না" না বলতে পারা,  "photogenic face"- ধারী ব্যক্তি পাকড়াও করে নিমেষের মধ্যে তাদের ছবি এঁকে এবং তাদেরকেই সেটা বিক্রি করে তাদের কাছে নিজের অসামান্য প্রতিভার মূল্য আদায় করা ।

২০১১ সালে আমার সাথে এই ঘটনা ঘটেছিলো। আজ আবার ঘটলো । অকস্মাৎ, বিশেষ কিছু ঠাহর করার আগেই ! শশুর বাড়ি থেকে ফেরার সময় কি মনে হলো, একবার একাডেমির সামনেটায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম আর প্রজাপতি বিসকুট সহযোগে চা সেবন করছিলাম । এমন সময় প্রায় মাটি ফুঁড়ে এই শিল্পীর আবির্ভাব ঘটলো ! যেমন নাম, তেমনি কাম ! আমার সাথে ঠিক ২ মিনিটের ভূমিকা -- "এই আপনাকে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে, আমি কিন্তু সবার ছবি আঁকি না, আপনি মুখের ওপর 'নেহি চাহিয়ে' বলা বড়োলোকের ব্যাটা নন" ইত্যাদি । আমিও ভ্যাবাচেকা খেয়ে দুর্বল বিবাদী পক্ষের উকিলের মতো অচল যুক্তি ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম  -- "মানে বলছি কি, এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে, তায় মহরম... রাস্তায় বাস কম, একটু তাড়া ছিলো" ইত্যাদি । কিন্তু আমার বিনীত অনুরোধে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে ইতি মধ্যে শিল্পীর ক্ষিপ্র হস্তের পেন্সিল কার্ডবোর্ডে আঁটা কাগজে ললিত কলা সৃষ্টি করতে শুরু করে দিয়েছে । আমি আরো বললাম -- "না মানে আপনি কিন্তু বেশ কিছু দিন আগে আমার ছবি এঁকেছিলেন, সে ছবি এখনো আমার কাছে রয়েছে" । এটা বলায় উনি থামলেন । আমি ভাবলাম, এইবার বোধ হয় ওষুধ ধরেছে । কিন্তু উল্টে আরও উৎসাহ পেয়ে শিল্পী বললেন -- "তবে ! হতেই  হবে ! আমায় কি হেঁজি পেঁজি পেয়েছেন নাকি ? আমার নাম মিঠুন চক্রবর্তী ! আর্টিস্ট ! তবে এ ক'বছরে  আমার হাত আরও খুলেছে ! আগেরটার সাথে এইটা মিলিয়ে নেবেন!" বলে দ্বিগুণ উৎসাহে কাগজে পেন্সিল সঞ্চালন করতে লাগলেন । আশপাশের লোকজন উৎসুক দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে, একবার শিল্পীর ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, কারো মুখে মিটি মিটি হাসি । আমার ঠিক বাম দিকে এক ডানপিটে ধরণের মেয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো । সে ফোঁকা থামিয়ে চোখের সামনে জলজ্যান্ত মূর্তিমান শিল্প অবলোকন করছিল । সামনের টিকেট কাউন্টারে অনুসন্ধানী লোকজন এদিকে দেখে কিসব কানাকানি করছিলেন । আমিও লজ্জা লজ্জা মুখ করে তাদের দিকে চাইছিলাম । তাই দেখে মৃদু হুকুম এলো "আমার দিকে তাকাবেন  দাদা" ! হুকুম তামিল হতেই তিনি বলে চললেন "আমার হাতের যে উন্নতি হয়েছে, একথা শুধু আমি বলছি না দাদা । স্বয়ং দিদি বলেছেন ! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় !" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম "তা আপনি কি ওনারও ...?"  "ধুর ওনার অত  সময় কোথায় ?? কিন্তু দিদি আমায় একাডেমির ভেতর জায়গা করে দিয়েছেন । দিদি জিন্দাবাদ ! আমার সামনে ওনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে রক্তারক্তি হয়ে যাবে এক্কেবারে !" আমি মনে মনে ভাবলাম "আমার ঘাড়ে কটা মাথা !" শিল্পী বলে চললেন (ওনার পেন্সিলের চলাচল অব্যাহত) -- "তবে শর্মিলা দিদি -- ওই যিনি 'আরাধনা' করেছিলেন, ওনার ছবি এঁকেছি ; রাজেশ খান্নার এঁকেছি, আপনাদের মিঠুনদার ছবি এঁকেছি । আজ আপনার আঁকছি !" শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । আর অসহায় ভাবে চিত্রিত হওয়া  ছাড়া আর কি করবো, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না! শিল্পীর হাত আর মুখ একই গতিতে চলছিল। হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছিলাম এনার নামের সার্থকতা ! শিল্পী বলে চলেছেন, ছবিতে ফিনিশিং টাচ দিতে দিতে, "তারকারা তো একদিন আঁকাবেন, ৫০০ টাকা দেবেন, ব্যাস ! কিন্তু আপনারাই তো আমাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, নাহলে কি আর ছবি এঁকে পেট চলে দাদা "!

অবশেষে আমার পোট্রেট শেষ হলো (attached) । আমার খুব যে মনোপূতঃ হয়েছিল তা নয়, কিন্তু মাত্র ৮-৯ মিনিটের মধ্যে এইটুকুও করা সহজ নয় । আমি এককালে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, প্রচুর ছবি আঁকতাম । কিন্তু একদিন নিজের চরম অযোগ্যতা বুঝতে পেরে ইতি টানি ! তাই শিল্পীদের প্রতি আমার মনে অনেকখানি সম্মান জমা রয়েছে, তা অনুভব করি কোনো শিল্পী এবং তাঁদের আঁকা ছবি দেখলেই । তাই হয়তো এবারেও মুখের ওপর না বলতে পারিনি । এছাড়া ২০১১ সালের সেই দিন আমরা "চিরকুমার সভা" দেখেছিলাম, খুব ভালো লেগেছিলো ! সেই সব সোনালী দিনের স্মৃতির ছবি মনে প্রাঞ্জল হয়ে উঠছিলো আজ এই পোর্ট্রেট আঁকানোর সময় । তাই  নির্বিবাদে শিল্পীকে তার কাঙ্খিত পারিশ্রমিক দিয়ে খুশি মনে বিদায় নিলাম আমার নতুন পোর্ট্রেট নিয়ে । ওনার হাত আরও ভালো হয়ে যাওয়ার কারণে আগের বারের চেয়ে কিছু বেশি নিলেন, বলাই বাহুল্য !

No comments:

Post a Comment